জিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুত্থানের স্মরণে আয়োজিত ইস্টার বলতে গেলে সপ্তদশ শতক থেকেই এ দেশে সাহেবদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সে সময়ের সামাজিক জীবনের বর্ণনায় কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট গুড ফ্রাইডে-র দিন উপবাস পালনের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন ইংরেজিতে ‘পায়াস’ অর্থাৎ পবিত্র অর্থে প্রযুক্ত ‘গুড’ শব্দটির ব্যবহারে এই উদ্যাপনের নামের শিকড়, মত অনেকের। তাই গ্রান্টের লেখায় তিনটি ‘গ্রেট ফিস্ট’ হিসাবে ইস্টার-এর উল্লেখ থাকলেও, এই সময়ে দান ও সমাজসেবার মতো ভাল কাজও ছিল উদ্যাপনের অঙ্গ।
বড়দিন ও ইস্টারে দুঃস্থদের জন্য দান সংগ্রহের আলাদা তহবিল গড়ে ওঠে ১৮০০ সালে। ব্যাঙ্ক অব হিন্দুস্তান-এ আলাদা খাতা খোলা হয় সে জন্য। বড়লাট জর্জ ইডেনের বোন এমিলি ইডেন ১৮৩৭-এর ইস্টার পালন করেন ব্যারাকপুরের বাগানবাড়িতে। সেখান থেকে এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে তিনি গুড ফ্রাইডের দিন খুব সুন্দর ধর্মোপদেশ শোনার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি জানিয়েছিলেন বড়লাট স্থাপিত স্থানীয় স্কুলে শিশুদের পড়াশোনায় অগ্রগতি, মনিটর বা ‘সর্দার-পড়ুয়া’দের মসলিনের পোশাক দেওয়ার কথাও। ১৯১৩ সালে ইস্টারের আগে শহরের ইংরেজি দৈনিকে দরিদ্রদের জন্য পোশাক ও অন্যান্য পুরনো জিনিস দানের আবেদন ছাপা হয়েছিল কলকাতার মিশন চার্চের তরফে। ইচ্ছুক দাতাদের ঠিকানায় চাপরাশি পাঠিয়ে জিনিসগুলি সংগ্রহের কথাও ছিল তাতে।
১৮৩৪ সালের ইস্টার সানডে-র শুভ দিনে ধর্মতলা স্ট্রিটে চার্চ অব দ্য সেক্রেড হার্ট অব দ্য জিসাস-এর উৎসর্গ-অনুষ্ঠান (কনসেক্রেশন) হয়। তার স্মৃতিফলক আজও আছে গির্জার দেওয়ালে। গথিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত, শহরের পর্তুগিজ ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন এই গির্জায় আছে জিশুর শেষযাত্রা বিষয়ে তৈরি চোদ্দোটি মার্বেল প্যানেল। ইউরোপে তৈরি এই অনবদ্য প্যানেলগুলির সঙ্গেও মিশে আছে ইস্টার উদ্যাপন-অনুষঙ্গ।
ছুটির মরসুম হিসাবেও ঔপনিবেশিক কাল থেকে ইস্টারের আলাদা কদর। ছুটি মানে খানাপিনাও, ইস্টারের খাবার বলতে প্রথমেই মনে আসে ইস্টার এগ আর হট ক্রস-বান’এর কথা। পুরনো বিজ্ঞাপন বলছে, ১৮৮৩ সালে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গুড ফ্রাইডে ও তার আগের দিন ভোর পাঁচটা থেকে বিক্রি হত হট ক্রস-বান। টাকায় ষোলোটি দরে বিকানো এই রুটি ‘সর্বোৎকৃষ্ট আমেরিকান ময়দার তৈরি’, এমন দাবি সেই বিজ্ঞাপনে। তবে এই খাবারের শুরুটা পাঁচতারা হোটেল থেকে বহু দূরে, মধ্যযুগের ইউরোপে গুড ফ্রাইডে উপলক্ষে সাধারণ্যে বিতরণের জন্য ক্রুশচিহ্ন-ছাপ রুটি হিসাবে। কলকাতার বেশ কিছু গির্জায় গুড ফ্রাইডে-তে বিতরিত রুটির উপর ক্রসচিহ্ন (মাঝের ছবি) আজও ধরে আছে সেই উত্তরাধিকার। ছবিতে ১৯৯৪ সালের মধ্য কলকাতায় ইস্টারের পদযাত্রা।
জন্মদিনে
“ভালো থিয়েটর আজকের মানুষের উপলব্ধি সঞ্চারিত করবে মানুষের মনে।... থিয়েটর তো মানুষের কথা বলবে... দর্শককে ভাবাবে।” বলতেন শাঁওলি মিত্র। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র যে স্বতন্ত্র নাট্যদর্শনের প্রবর্তন করেছিলেন, তার উত্তরাধিকার যাপন করতেন শাঁওলী। ‘পঞ্চম বৈদিক’ নাট্যগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ৫ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনে ‘শাঁওলী মিত্র স্মারক সম্মান’-এর প্রবর্তন করতে চলেছে নাট্যগোষ্ঠীটি। সম্মানিত হবেন অনসূয়া মজুমদার। ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের পাগলা ঘোড়া, যদি আর এক বার, পাখি, রাজা, মৃচ্ছকটিক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনার অভিনেত্রী তিনি। পরবর্তী কালে তাঁর অভিনীত আগশুদ্ধি, রানী কাহিনী প্রভৃতি নাটক দর্শকমনে আজও স্মৃতিধার্য। শিশির মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এই সম্মাননা অনুষ্ঠানটি। সঙ্গে শাঁওলী মিত্রের নাটক নাথবতী অনাথবৎ-এর পাঠ-অভিনয়, অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায়।
অনন্য অর্ঘ্য
বিশ্ব নাট্য দিবস চলে গেল গত ২৭ মার্চ। কলকাতার রুশ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গোর্কি সদনে দিনটি পালিত হল অন্য এক ঐতিহাসিক অনুষঙ্গকে মনে করিয়ে: বাংলা থিয়েটারের পথিকৃৎ, ভাষাতাত্ত্বিক ও ভারততত্ত্ববিদ গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেভ-এর জন্মের ২৭৫ বছর উদ্যাপন। আইজ়েনস্টাইন সিনে ক্লাবের উদ্যোগে সন্ধ্যার মূল বক্তা ছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়; দর্শক-শ্রোতারা উপভোগ করলেন শ্রুতিনাটক ‘ছায়াপথের কাছে’, টেলি-সিরিয়াল লেবেদেভ কি নায়িকা-র বিরল দৃশ্যশ্রাব্য অংশ। লেবেদেভ স্মরণে তিন দিনব্যাপী এক প্রদর্শনী শেষ হল গতকাল: মস্কো আর্ট থিয়েটারের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, রুশ থিয়েটারের মূল পোস্টার, বাংলা নাটকের বিরল ও পুরনো বুকলেট, আলোকচিত্রী কোয়েলার ক্যামেরায় সমসময়ের মঞ্চাভিনেত্রীদের ছবিতে সেজে ওঠা।
ছবির উৎসবে
২০১৩-তে শুরু হয় এনইজ়েড ফাউন্ডেশন, সিনেমা সাহিত্য ও অন্য শিল্পমাধ্যমের চর্চায়। গত আট বছর ধরে ‘এনইজ়েড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজন করছে তারা, ছবি দেখানো ছাড়াও আলোচনা হয় বিষয় ধরে। নবম বছরের উৎসবে সঙ্গী ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস-ও। আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে শুরু হয়েছে গতকাল, সন্ধেয় ছিল আলোচনাও: ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে সিনেমার নানা দিক নিয়ে। গতকাল ও আজ দু’দিনে একগুচ্ছ কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র, অ্যানিমেশন ও ছোট ছবি: আজ ১২.৪৫ থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত তিনটি ভারতীয় কাহিনিচিত্র হেক্সিং, দ্য ডিফেক্টিভ ডিটেক্টিভস, টকিং টু মিকেলাঞ্জেলো আর তথ্যচিত্র সুন্দরবনস: সাগা অব হাংরি টাইডস; ফ্রান্স চিলি রাশিয়ার ছোট ছবি।
কথায় গানে
১৯৮৩-তে যাত্রা শুরু ‘অভিজ্ঞান’-এর। শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার প্রতিষ্ঠান নয়; সে গান বুঝে, কণ্ঠে ও মনে ধারণের পীঠভূমি, এমনই ভাবেন শিক্ষার্থী সদস্যেরা— কর্ণধার অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে। এই ধারাতেই ওঁরা উপহার দিয়েছেন স্বল্পশ্রুত রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর, ২০১৫ থেকে সাঙ্গীতিক কর্মশালা ও আলোচনাচক্রও: রবীন্দ্রগান গাইতে বুঝতে গেলে যে সব ধারার গানের সঙ্গে পরিচিতি জরুরি, তার সঙ্গে পরিচয় করান সংস্কৃতি-জগতের বিশিষ্টজন। এ বছর কর্মশালা ও আলোচনা ৩০-৩১ মার্চ, যাদবপুরে ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে। ‘কথায় গানে সবার প্রাণে’ বিষয়ে বলবেন শ্রাবণী সেন সৈকত মিত্র চন্দ্রাবলী রুদ্র দত্ত বাদশা মৈত্র প্রবোধ ধর চক্রবর্তী প্রমুখ।
ইতিহাস-চর্চা
গ্রিক পুরাণে ইতিহাসের প্রেরণাদাত্রী তথা মিউজ় ক্লিয়ো। তাঁর উদ্যাপন মানে ইতিহাস-চর্চারও উদ্যাপন, এই ভাবনা থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় (স্বশাসিত) নরেন্দ্রপুর-এর ইতিহাস বিভাগ ২০১৭ থেকে আয়োজন করে আসছে অ্যাকাডেমিক ফেস্ট ‘ক্লিয়োভেঞ্চার’। ইতিহাসকেন্দ্রিক একটি মূল ভাবনার নির্বাচন, তাকে ঘিরে নানা সঙ্গ-অনুষঙ্গ যাচাই, ভাবনা ও আলোচনার বিনিময়— এই নিয়েই একটি দিনের বৌদ্ধিক উৎসব। কলকাতা ও কাছেপিঠের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই উৎসবের প্রাণ, তাঁরাই ‘পেপার’ পড়েন, অংশ নেন কুইজ়ে, মন দিয়ে শোনেন আমন্ত্রিত বিশিষ্টজনের কথাও। এ বছরের উৎসব-বিষয় ‘ফিল্মিং হিস্ট্রি’, ইতিহাস ও চলচ্চিত্রের আন্তঃসম্পর্ক। ২ এপ্রিল কলেজ প্রেক্ষাগৃহে, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
প্রতিরোধী শিল্প
এ-ও এক বিপ্লব। এই শতকের প্রথম দশকেও যে শিল্পীর ছবিতে ছিল ইম্প্রেশনিজ়ম আর সুরিয়ালিজ়মের প্রাবল্য, পরের দশকেই তা গেল বদলে। কারণ বদলাচ্ছিল সময়; যে সমাজে বসে শিল্পীর ছবি আঁকা, বদলাচ্ছিল তার রাজনীতি: সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, পালাবদল ঘিরে। মানুষের বোধের বদল ধরা দিল অভিজিৎ মিত্রের পরবর্তী কালের ছবিতে, ইমেজ কম্পোজ়িশন আঙ্গিকে ঘটল মৌলিক রূপান্তর। হিংসা, মৃত্যু যখন ঘনায় চার পাশে, জেগে ওঠে প্রতিরোধ, ছবিও তখন হয়ে ওঠে প্রতিবাদী, তুমুল রাজনৈতিক। অভিজিৎ মিত্রের আঁকা সেই চিত্রকৃতিগুলি এ বার দেখা যাবে ‘রেজ়িস্ট্যান্স অ্যান্ড রেজ়িলিয়েন্স’ প্রদর্শনীতে, সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস-বি আর পানেসর গ্যালারিতে, কসবায়। আজ শুরু, ৭ এপ্রিল অবধি বিকেল ৪টে থেকে রাত ৮টা, শুধু ৩ এপ্রিল বিরতি।