Dengue

ডেঙ্গি ‘চেপে’ দিতে রক্তচক্ষু প্রশাসনের

কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ডেঙ্গি-আতঙ্ক যখন বেড়েই চলেছে, তখন পুরসভা এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর তাদের ‘রিপোর্ট কার্ড’ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নানা ভাবে তথ্য গোপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে দফতরেরই অন্দর থেকে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:৩১
Share:

সম্প্রতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাদে মশার লার্ভার খোঁজে মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ। ফাইল চিত্র

কলকাতায় এই মরসুমে ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা কত? এই প্রশ্নে এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদের জবাব, ‘শূন্য’। আর রাজ্যে? স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা রীতিমতো আমতা-আমতা করতে থাকেন। ‘‘একেবারেই নগণ্য। রিপোর্ট দেখে বলতে হবে।’’ আক্রান্তের সংখ্যাও ‘যথেষ্ট কম’!

Advertisement

কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ডেঙ্গি-আতঙ্ক যখন বেড়েই চলেছে, তখন পুরসভা এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর তাদের ‘রিপোর্ট কার্ড’ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নানা ভাবে তথ্য গোপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে দফতরেরই অন্দর থেকে। স্বাস্থ্য দফতর ডেঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। এ বার এমনকী এ-ও অভিযোগ উঠেছে যে শহরের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে ডেঙ্গি নির্ণায়ক পরীক্ষা নিয়েও পুরসভা এবং স্বাস্থ্য দফতর অলিখিত ফতোয়া দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গির রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ এলেও ‘নেগেটিভ’ দেখাতে বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ল্যাবরেটরির কর্তা। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন, কোথাও এমন ফতোয়া দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, ‘‘বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলি বাণিজ্যিক কারণে ডেঙ্গির পরীক্ষা করে। অকারণ এত পরীক্ষার তো দরকার নেই। সেটায় রাশ টানতে চেয়েছি।’’ প্রশ্ন হলো, কোনও বেসরকারি ল্যাবে কেউ যদি নিজের খরচে, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে কোনও রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা করাতে চান, তা হলে পুরসভা সেখানে বাধা দেওয়ার কে? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একাংশের দাবি, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকেই তাঁদের কাছে এ ব্যাপারে কড়া নির্দেশ রয়েছে। কোনও ভাবেই ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখানো চলবে না। ইতিমধ্যেই একাধিক হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্র এ ব্যাপারে সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েছে। এমনকী বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে মশার লার্ভা মেলার পরে কেন সাংবাদিকরা সেখানে ছবি তোলার সুযোগ পেলেন, সে নিয়েও তিরস্কৃত হতে হয়েছে হাসপাতাল প্রশাসনকে। দফতরের কর্তাদের একটা বড় অংশই স্বীকার করেছেন, আগাম যথেষ্ট তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গি নিয়ে এই লুকোচুরির প্রবণতাই সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কোথায় কত জন আক্রান্ত হচ্ছেন, কত জন মারা যাচ্ছেন তা জানা থাকলে রোগ মোকাবিলায় সুবিধা হয়। তা না করে আক্রান্ত-মৃত সবেতেই শূন্য দেখাতে গিয়ে এ বারেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।’’

Advertisement

যদিও স্বাস্থ্যকর্তারাই মানছেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার ডেঙ্গি মরসুম শুরুর আগেই তা প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনেক আগেভাগে রোগ প্রতিরোধে সতর্কতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে যখন আগেভাগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে উদ্যোগী হলেন, তখন রোগের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভার তরফে এমন ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন?

সদ্য কসবায় একই দিনে একই পরিবারে বাবা ও ছেলের ডেঙ্গিতে মৃত্যুর পরে এই প্রশ্ন বেশি করে সামনে এসেছে। শহরের দুই হাসপাতাল এ ক্ষেত্রে বাবা ও ছেলে দু’জনের মৃত্যুর কারণকেই ডেঙ্গি বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে লড়ে যাচ্ছেন অতীনবাবু। এত বিতর্কের পরে সোমবারও তিনি বলেন, ‘‘ছেলেটির ডেঙ্গি হয়ইনি। রিপোর্ট ভুল ছিল। আর বাবার ডেঙ্গি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা মৃত্যুর কারণ নয়।’’ তাহলে মৃত্যুর কারণ কী? মেয়র পারিষদের ব্যাখ্যা, ‘‘একমাত্র ছেলের মৃগী রোগ। সে বেশি দিন বাঁচবে না। এ নিয়ে বাবা খুবই মানসিক অশান্তিতে ছিলেন। তাঁর হার্টের সমস্যা ছিল। সব মিলিয়ে এমন হয়েছে। এটাকে আমরা ডেঙ্গি মৃত্যু বলে ধরছি না।’’

মেয়র পারিষদের এই বক্তব্যকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মনে করছেন খোদ পুরসভার চিকিৎসকেরাই। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এ ভাবে সত্যিকে চাপা দিতে গিয়ে ডেঙ্গি শক সিনড্রোমকে অস্বীকার করার নজির বড় একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। মেয়র পারিষদ সংবাদমাধ্যমে নিজের লার্ভা খোঁজার ছবি তোলাতে যত উৎসাহী, রোগ মোকাবিলায় যদি তার ছিটেফোঁটাও আগ্রহী হতেন, তা হলে শহরবাসীর পক্ষে মঙ্গলের হত।’’

অতীনবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, তথ্য গোপনের প্রশ্নই ওঠে না।
তাঁর আক্ষেপ, ‘‘ডেঙ্গি তো নোটিফায়েবল অসুখ। সরকারি-বেসরকারি কোনও হাসপাতাল নিজে থেকে জানায় না। ডাক্তাররাও জানান না। বারবার স্বাস্থ্য ভবনকে বলেও কোনও লাভ হয়নি। তাই আমরা নিজেরাই খোঁজ নিই। আমাদের ১৪১টি ওয়ার্ডে তথ্য সংগ্রাহক রয়েছেন। গোপন করতে চাইলে তাঁদের নিয়োগ করতাম নাকি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement