অবাধে: বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের বরফ দিয়েই তৈরি হচ্ছে পানীয়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
‘‘বরফ লাগবে?’’ ‘‘হ্যাঁ।’’ শুনেই চাঁই থেকে বরফ ভাঙতে লাগলেন তিনি। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ। এখনই যা গরম পড়ছে, সকলে বলছেন, যেন জ্যৈষ্ঠ! তবু রবিবার রাতে বৃষ্টি হওয়ায় সোমবার তুলনামূলক ভাবে গরম কম। না হলে তো পারদ হু হু করে বাড়ছে!
যেমন ভাবে বাড়ছে সুশীল দাসের ঠাণ্ডা পানীয়, শরবতের বিক্রি। শহিদ মিনারের কাছে সুশীলবাবুর ঠান্ডা পানীয় বিক্রির ব্যবসা। বরফ ভাঙতে ভাঙতে সুশীলবাবু বলছিলেন, ‘‘গরমটাই তো আমাদের বিক্রির সময়। তার উপরে এই সময়ে আবার ভোট পড়েছে। এ জন্য বাড়তি কিছু খদ্দের আসেন। তাই অন্য সময়ের তুলনায় বিক্রি একটু বেশিই হয়।’’ কিন্তু এই বরফ বিক্রি তো বন্ধ! তা-ও যে বিক্রি করছেন? সুশীলবাবুর চটজলদি উত্তর, ‘‘ওই ধর্মতলার দিকটায় পুরসভা মাঝেমধ্যেই আসে বটে। তাই তো ও দিকটা যাই না। এখানে অবশ্য কোনও অসুবিধা নেই।’’
কলকাতার ‘বরফ-সাম্রাজ্য’ এ ভাবেই ভাগ হয়ে গিয়েছে। বরফের চাঁই নিয়ে সুশীলবাবুর উক্তি থেকেই তা স্পষ্ট হয়। এক দিকের চিত্র, পুরসভার লাগাতার অভিযানের ফলে ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট-সহ শহরের মূল কেন্দ্রগুলিতে ঠান্ডা পানীয়, শরবত, ফলের রস বিক্রেতারা খাওয়ার বরফ বা ‘আইস কিউব’ রাখছেন বা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। মূল কেন্দ্র থেকে একটু দূরে গেলেই অন্য চিত্র। সেখানে মাছ, আনাজ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বরফের (ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইস) রমরমা! কে দেখছেন, কে-ই বা আটকাচ্ছেন! বছর-বছর গ্রীষ্মের এক ছবি। তার সামান্য পরিবর্তনও নেই।
তবে নির্বাচনী প্রচারের জন্য মিটিং-মিছিলের জেরে এই গ্রীষ্ম কিছুটা আলাদা, বলছেন ঠান্ডা পানীয়ের বিক্রেতারা। ফলে বাড়তি লোকজনের আনাগোনা হচ্ছে। তাই পানীয়ের চাহিদা বাড়ায় চড়ছে বিক্রি। শ্যামবাজারে ঠান্ডা পানীয়ের এক বিক্রেতার কথায়, ‘‘মিছিল থাকলে বা কোথাও সভা হলে সেখানে চলে যাই। তখন বিক্রিও খুব হয়। এখনই যা গরম পড়েছে!’’
এই বিক্রি পর্বে ক্রমাগত পিছনে চলে যাচ্ছে সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বরফ এবং খাওয়ার বরফ পৃথকীকরণের প্রক্রিয়া। গত বছরই বাণিজ্যিক বরফে নীল রং করতে হবে বলে কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা কমিশনের তরফে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল। ওই নির্দেশিকায় বাণিজ্যিক বরফকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্য তাতে ইন্ডিগো কারমাইন নামে একটি রাসায়নিক নির্দিষ্ট মাত্রায় মেশানোর কথা বলা হয়েছিল। এর পরে নড়ে বসেছিল কলকাতা পুরসভাও। কিন্তু বছর ঘুরতে চললেও সে প্রক্রিয়ায় কোনও অগ্রগতি হয়নি বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এটা তো পুরসভার বিষয় নয়। পুরসভা শুধু নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু সেই নির্দেশিকা তো এখনও জারিই হয়নি। তবু আমরা নিয়মিত অভিযানটা জারি রেখেছি।’’
দু’নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সাধন সাহা বলেন, ‘‘এখন তো আমরা বরোভিত্তিক অভিযানও চালাচ্ছি। চেষ্টা করছি বরফের চাঁই দেখলেই তা ফেলে দেওয়ার। কিন্তু তার পরেও বিক্রি হচ্ছে।’’ আসলে তেষ্টা পেলে তখন কোন বরফ পানীয়ে মেশানো হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্রেতাই তা খেয়াল করেন না বলে জানাচ্ছেন ছ’নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সঞ্চিতা মণ্ডল। এ সবের ফলেই অবাধে চলছে পানীয়ে সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বরফের ব্যবহার। সঞ্চিতার কথায়, ‘‘যত ক্ষণ না যেখানে বরফ তৈরি হচ্ছে, সেখানে কোনও নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে, তত ক্ষণ এমন পরিস্থিতি আটকানো যাবে না।’’ বরফ কারখানা থেকেই আকৃতিগত পার্থক্য তৈরি জরুরি বলে মনে করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়ো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক প্রশান্তকুমার বিশ্বাস। তিনি বলছেন, ‘‘ইন্ডিগো কারমাইন যদি মেশানো সম্ভব না-ও হয়, তা হলেও কোনটা খাওয়ার বরফ তার আকৃতি কারখানায় তৈরির সময় থেকেই বাধ্যতামূলক ভাবে পাল্টে দেওয়া দরকার। তার কারণ শুধুমাত্র খাওয়ার বরফ তৈরি করার কোনও কারখানা এ শহরে আছে বলে আমাদের সমীক্ষায় ধরা পড়েনি। যাতে ক্রেতারা বুঝতে পারেন, এই বরফ নিরাপদ।’’
কিন্তু সেই ‘নিরাপদ’ বরফ কোথায়, এখনও জানে না এ শহর!