হাতে দু’হাজারের নোট, ভাঙিয়ে দেবে কে

গোলাপি কাগজটা হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হাসলেন শহীদনগরের বাসিন্দা নির্মল অধিকারী। ভাল করে নেড়েচেড়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কাগজটার মাহাত্ম্য। তাঁর আশপাশে ভিড় জমিয়েছেন আরও কয়েক জন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:০৭
Share:

দু’হাজারি নিজস্বী। বৃহস্পতিবার, হাওড়ায়। — দীপঙ্কর মজুমদার

গোলাপি কাগজটা হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হাসলেন শহীদনগরের বাসিন্দা নির্মল অধিকারী। ভাল করে নেড়েচেড়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কাগজটার মাহাত্ম্য। তাঁর আশপাশে ভিড় জমিয়েছেন আরও কয়েক জন। হবে না-ই বা কেন, গোলাপি কাগজটা যে আসলে নতুন দু’হাজার টাকার নোট! যেটা এই প্রথম বারের জন্য ছুঁয়ে দেখছেন সাধারণ মানুষ।

Advertisement

বিমল দে আবার চোখ কুঁচকে নোটে খুঁজে চলেছেন ‘‘জিএসএম-টা কোথায়?’’ বস্তুত, নতুন নোট প্রকাশ হওয়ার আগেই গুজব রটেছিল, নোটের গায়ে নাকি বৈদ্যুতিন জিএসএম চিপ থাকবে। যার মাধ্যমে কার কোথায় কত লুকনো নোট থাকছে, তা ধরা যাবে।

কলেজ-পড়ুয়া সৌরীন ধর ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েই একগাল হেসে বললেন, দু’হাজারের বড় নোটটার সঙ্গে একটা নিজস্বী তুলে ফেসবুকে পোস্ট করবেন সবার আগে। আহ্লাদে ডগমগ তরুণী প্রিয়াঙ্কা সরকার জানালেন, কী সুন্দর গোলাপি রং নতুন নোটের! চেহারাটাও অনেকটা ডলারের মতো!

Advertisement

নতুন গোলাপি নোটে প্রাথমিক ভাবে মেতেছেন সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটিরাও। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনও নতুন নোটের ছবি দিয়ে টুইট করে বলেছেন, ‘‘নতুন দু’হাজারি নোট গোলাপি রঙের! ‘দ্য পিঙ্ক এফেক্ট’!’’

নোট-সংশয়ের প্রাথমিক ধাক্কা পার করে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে লাইন দিয়েছেন মানুষ। পাঁচশো-হাজারের বাতিল নোট জমা দেওয়া শুরু হয়েছে। নতুন টাকাও মিলছে। বাতিল টাকা জমা করে নতুন নোটে হাতে পাচ্ছেন চার হাজার টাকা করে। তবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কয়েকটি শাখা ছাড়া নতুন টাকা দিতে পারেনি প্রায় কেউই। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেই এখনও নতুন নোট পৌঁছয়নি। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি কয়েক জনকে দিয়েছেন চল্লিশটা করে একশো টাকা। তবে তা চাহিদার তুলনায় কিছুই নয়।

যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে নতুন নোটে চার হাজার টাকা মিলছে, তাতেই থাকছে একটি দু’হাজার টাকার নোট, আর কুড়িটি একশো টাকার নোট। কিন্তু নতুন নোটের প্রাথমিক আনন্দটুকু সামলেই যে প্রশ্নটা গুনগুনিয়ে উঠছে, ‘‘এত বড় নোট নিয়ে করব কী!’’

বেহালার পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। চার হাজার টাকা পকেটস্থ করে বাড়ি ফিরেছিলেন। গিন্নির হাতে টাকা তুলে দিতেই প্রশ্নবাণ, ‘‘এত বড় নোট কোথায় ভাঙাব টাকা?’’ মাছ, মুদি, খবরের কাগজ, ড্রাইভারের বেতন, ওষুধের দোকান— কোনও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আসবে না এই দু’হাজারি নোট।

বাস্তব পরিস্থিতি তো তাই-ই। ছোটখাটো খরচ দু’-এক দিন একশোর নোটে চালিয়ে নেওয়া গেলেও, সাতশো-হাজার-বারোশো টাকার খরচগুলোয় হাত-পা বাঁধা পড়বে সাধারণের। বিপদে পড়বেন ব্যবসায়ীরাও। ধরা যাক, হাজার টাকার জিনিস কিনলেন কেউ। দশটা একশো টাকার নোট খরচ করা সম্ভব নয় এই পরিস্থিতিতে। হাতে রইল দু’হাজারের নোট। দোকানদারকে সেটা ধরালেই মুখ ভার তাঁর। কারণ দশটা একশো টাকার নোট ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক সায়ন্তনী অধিকারী পাটুলির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় বৃহস্পতিবার চার হাজার টাকা বদলে ফেললেও অন্য সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘‘ব্যাঙ্ক একটা দু’হাজার, বাকি একশোটা কুড়ি টাকার নোট দিয়েছে!’’ কুড়ি টাকার নোট দিয়ে তো কয়েকশো টাকার জিনিস কেনা যাবে না। আবার কয়েকশো টাকার জিনিস কিনে দু’হাজারের নোটও ধরানো যাবে না। পূর্ণেন্দুবাবু বা সায়ন্তনীর মতো চিন্তায় মাথায় হাত পড়েছে সাধারণ মানুষের। নতুন নোট পাওয়ার আনন্দ ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ‘‘এ বার কী হবে?’’

তবে চিন্তামুক্ত অনেকেই। টালিগঞ্জের ব্যবসায়ী ত্রিদিব ঘোষদস্তিদার যেমন জানালেন, ব্যবসায় বড় পরিমাণ টাকার লেনদেন হয় প্রায়ই। তাঁর বরং সুবিধাই হল দু’হাজারি নোট হাতে পেয়ে। শহিদনগরের নির্মল অধিকারীও বললেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে একটু সমস্যা হবেই। কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বড় বিল করতে হবে হয়তো। তবে আরও বেশি একশো আর নতুন পাঁচশোর নোট চালু হলে আস্তে আস্তে মিটবে সমস্যা।’’

আবার বেহালা বাজারের মাছ-ব্যবসায়ী স্বপন কুণ্ডু বললেন, ‘‘খদ্দেরের কাছেও খুচরো নেই, আমার কাছেও নেই। ব্যবসাটা হবে কী করে? চার-পাঁচশো টাকার মাছ কিনে কী ভাবে টাকা দেবেন তিনি? বড় নোট দিলে আমিই বা কী ভাবে ফেরত দেব?’’

এই সব নোট-প্রশ্ন চোখে নিয়েই আগামী দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন আমজনতা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement