সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। জল জমে গিয়েছিল রাস্তায়। কিন্তু, নির্ধারিত দিনে পৌঁছতে না পারলে যে বিপদ বাড়বে। তাই প্রবল বৃষ্টি মাথায় করেই সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে প়়ড়েছিলেন মা। বার কয়েক বমি করেছে মেয়েটা। অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল চত্বরের এক কোণে তাকে বসিয়ে, বহির্বিভাগের টিকিট কেটে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছন। কিন্তু চিকিৎসা তো জোটেইনি। উল্টে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি ওই মহিলা এবং তাঁর অসুস্থ মেয়েকে বার করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
অভিযোগ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সম্প্রতি এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাসিন্দা ওই মহিলার। ওই হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার এবং চিকিৎসা না করার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। হাসপাতালের সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পাশাপাশি বিষয়টি জানিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকেও।
রোগীর পরিজনেরা জানিয়েছেন, গত ২৫ জুন টালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাসিন্দা রিয়া মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) বছর পনেরোর মেয়েকে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন। সকাল দশটা নাগাদ বহির্বিভাগের টিকিট কেটে মেয়েকে নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু অভিযোগ, চিকিৎসক স্বর্ণলতা রায় অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রীর চিকিৎসা করতে রাজি হননি। উল্টে জানিয়ে দেন, ডায়মন্ড হারবার হাসপাতাল থেকে মেয়েটির চিকিৎসা হবে।
কিন্তু শেষ দশ বছর তো ওই ছাত্রীর চিকিৎসা চলছে মেডিক্যাল কলেজেই। প্রতি মাসে রক্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ-ইঞ্জেকশনও দেয় ওই হাসপাতাল। তা হলে সেখানে পরিষেবা পাওয়া যাবে না কেন?
রিয়ার অভিযোগ, ওই চিকিৎসক তাঁদের জানান, নতুন নিয়মে জেলার হাসপাতাল থেকেই পরিষেবা নিতে হবে। কিন্তু টালিগঞ্জ ফাঁড়ির যে এলাকায় রিয়া থাকেন, সেটা কলকাতা পুরসভার ১১৬ নম্বর ওয়ার্ড। তাঁদের বাড়ির পিন কোড কলকাতা-৫৩। তার পরেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়নি।
রিয়ার আরও অভিযোগ, মেয়ের অবস্থা ক্রমে খারাপ হওয়ায় তিনি বারবার চিকিৎসা শুরু করার অনুরোধ জানালে ওই চিকিৎসক স্বর্ণলতা রায় রোগীর নথি ছুড়ে ফেলে দেন। রিয়াকে বলেন, ‘‘বেরিয়ে যাও। না হলে সিকিওরিটি ডেকে বার করে দেব।’’
বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন ওই মহিলা। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের পরামর্শেই লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার কাছে। শুক্রবার রিয়া বলেন, ‘‘মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার চিকিৎসা। সরকারি হাসপাতাল পরিষেবা না দিলে কোথায় যাব? কলকাতায় থাকি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাসপাতালও তো ঠেলে পাঠিয়ে দেবে! মেয়েটাকে বাঁচাব কী করে?’’
যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেয়েটির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে, তার সম্পাদক শৈলেন ঘোষ বলেন, ‘‘বাচ্চাটি যাতে যথাযথ পরিষেবা পায়, তার জন্য লড়াই চলবে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য ভবন ঘেরাও করা হবে।’’
স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট জেলার হাসপাতাল থেকেই করানোর নির্দেশ রয়েছে। কারণ, জেলার রোগীরা শহরের মেডিক্যাল কলেজে এলে সেখানে চাপ বাড়ে। রোগীর চাপ কমাতেই এই পরিকল্পনা। কিন্তু, কোনও রোগী বহির্বিভাগে টিকিট কেটে হাসপাতালে গেলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া বা দুর্ব্যবহার করা অন্যায়। যদি রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে তিনি যে জেলারই বাসিন্দা হোন না কেন, হাসপাতালে পরিষেবা পাওয়ার অধিকার তাঁর রয়েছে। চিকিৎসক স্বর্ণলতা রায়ের সঙ্গে এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ওপিডি-তে রোজ ১০০ রোগী আসে। অত মনে নেই!’’
ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে তিন দিন। স্বাস্থ্য দফতর কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যকে ফোন ও এসএমএস করা হলেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।