কূটনীতির ফাঁদে ভেস্তে যেতে বসেছে গর্বিত হওয়ার মুহূর্ত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুতিনের মিসাইল এখনও পড়েনি। কিন্তু বরাহনগরে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা!
কূটনীতির ফাঁদে ভেস্তে যেতে বসেছে গর্বিত হওয়ার মুহূর্ত।
প্রতি চার বছরে এক বার সারা বিশ্বের বিশিষ্ট সকল গণিতজ্ঞ জড়ো হন কোনও একটি দেশে। সেখানেই হয় হালের গবেষণা নিয়ে চর্চা। উল্লেখযোগ্য গবেষণার জন্য ৪০ অনূর্ধ্ব দুই, তিন বা চার গণিতজ্ঞকে দেওয়া হয় ‘ফিল্ডস মেডেল’। যা কি না অঙ্কে নোবেল জয়ের সমতুল্য।
‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথামেটিশিয়ানস’ (আইসিএম) হল আঁকজোঁকের জগতে সবচেয়ে সম্মানিত সমাগম। ১৮৯৭ সালে প্রথম সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে হয়েছিল এই কনফারেন্স। সেই থেকে প্রতি চার বছর অন্তর কখনও রোম, কখনও বার্লিন কখনও বা অন্য কোনও শহরে বসে গণিতচর্চার সমাবেশ। আগামী দিনে কোন দিকে যাবে অঙ্ক নিয়ে গবেষণার দিশা, তা-ও আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয় এখানে। এ বছর গণিতের সেই ‘বিশ্বকাপ’-এর আসর বসার কথা ছিল রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে।
এমন সমারোহে বক্তৃতা রাখার জন্য আমন্ত্রণ পাওয়া মানে এক অর্থে ‘হল অব ফেম’-এ যোগ দেওয়ার মতো সম্মান। এমনই মনে করা হয় বিশ্বজুড়ে। পৃথিবী বিখ্যাত প্রায় সকল গণিতজ্ঞ এই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এ বছর সেখানেই একসঙ্গে ডাক পেয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত পাঁচ গণিতজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে তিন জন নীনা গুপ্ত, মালবিকা প্রামাণিক এবং মহেশ কাকড়ে আবার বরাহনগরের ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট’ (আইএসআই)-এর প্রাক্তন ছাত্র।
এমন আমন্ত্রণ সচরাচর পায় না কলকাতা। বিশ্বখ্যাত গণিতজ্ঞদের ভিড়ে মিশে বরাহনগর আইএসআই-এর নাম উজ্জ্বল করতেন তিন তারকা গণিতজ্ঞ। ফলে আইএসআই-এর গর্বের অন্ত ছিল না।
কিন্তু সে গর্বে জল ঢেলে দিয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। বা ভ্লাদিমির পুতিনের মিসাইল। আগামী ৬ থেকে ১১ জুলাইয়ের সেই অধিবেশন রাশিয়ায় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথামেটিক্যাল ইউনিয়ন’ (আইএমইউ)। যুদ্ধ যত দিনই গড়াক না কেন, রাশিয়ায় গণিতজ্ঞদের সমাবেশ আপাতত নৈব নৈব চ।
এ এক প্রকার প্রতিবাদও বটে। আইএমইউ-এর তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হচ্ছে সংগঠনের তরফে। এমন পরিস্থিতিতে সে দেশে কোনও সমাবেশ করা ঠিক হবে না বলেই মত প্রকাশ করেছেন আইএমইউ-এর সদস্যরা। সংগঠনের ওয়েবসাইটে সমকালীন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে লেখা হয়েছে, ‘রাশিয়ার এই পদক্ষেপের কঠোর নিন্দা করছি আমরা। ইউক্রেনের সকল সহকর্মী ও নাগরিকের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা রয়েছে।’
এই পরিস্থিতিতে আইএমইউ রাশিয়ার বাইরেই ওই সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতেও ঘোরতর সমস্যা! এখন হাতে অত সময় নেই যে, নতুন অনুষ্ঠানস্থল বেছে নিয়ে সব আয়োজন সম্পন্ন করা যাবে। সংগঠনের কর্তারা এমনও ভেবেছিলেন যে, আপাতত পিছিয়ে দেবেন সমাবেশ। পরে কোনও সময়ে নতুন করে আয়োজন করবেন। শেষে তাঁদের মনে হয়, এই সমস্যা সমাধানের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তখন সিদ্ধান্ত হয়, এ বছর সবটাই হবে ‘অনলাইনে’।
অনলাইন ব্যবস্থায় এখন নানা কাজ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। তাতে ভাবনার আদানপ্রদান বা পুরষ্কার ঘোষণায় কোনও বাধা প়ড়বে না ঠিকই। কিন্তু সেই গুণিজন সমাগমও হবে না। অনেকেই মনে করছেন, এ যেন বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েও মাঠে না নামতে পারার দুঃখ!
আইএমসি-তে আমন্ত্রিত নীনা গুপ্তও সমাবেশ অনলাইনে হবে শুনে বেশ হতাশ। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, ‘‘আইএমসি-তে এ বারই প্রথম যোগ দেওয়ার ডাক পেয়েছি। এমন সুযোগ সব সময়ে আসে না। কত অভিজ্ঞ গণিতজ্ঞের সঙ্গে আলাপ হয় সমাবেশে গেলে। নতুন গবেষণার পরিকল্পনা করা যায়। অনলাইনে সে সব কিছুই হবে না। সে কথা ভেবেই মন খারাপ হচ্ছে। আশা করি পরে আবার কখনও সুযোগ পাব।’’
যুদ্ধের যে এমন প্রভাবও পড়তে পারে কলকাতার উপর, তা বোধ হয় আগে কখনও ভাবেনি বরাহনগরের এই প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র। এত জন ভারতীয় গণিতজ্ঞ আইএমসি-র মঞ্চে বক্তৃতা করলে নাম উজ্জ্বল হত তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। কিন্তু ইউক্রেনে ছোড়া মিসাইলের জেরে যে আহত হবে বরাহনগর, তা কে জানত!