কাল রাতেই বাবা বলেছে পুজোয় বেশি ঘোরাফেরা নয়। একে ক্লাস ইলেভেন, তায় আবার পুজো শেষে পরীক্ষা। মায়ের কাছে ঘুরঘুর করেও লাভ হয়নি বিশেষ। অগত্যা মনের দুঃখ জানানোর উপায়— হোয়াট্স অ্যাপ। পাঁচ বন্ধুর আলাদা গ্রুপে কথাটা বলতেই জানা গেল, ফরমান জারি হয়েছে সর্বত্র। তাহলে কি এ বার টক-ঝাল ফুচকা থেকে ম্যাডক্সে আড্ডা, সবই বাদ?
ভাবতে না ভাবতেই সায়নের মেসেজ। ও নাকি খোঁজ পেয়েছে, এ বার বেশ কিছু পুজোর থিম পরিবেশ। আর সেগুলো দেখে পরীক্ষায় রচনা লিখতে অনেক সুবিধা হবে, তা বাড়িতে বললেই নাকি সবাই এক কথায় রাজি হয়ে যাবে। সায়নের প্ল্যানে অবশ্য বিশেষ ভরসা নেই টিকলি, সুমনা, মিঠি আর শ্রীময়ের। তবে বিপদে পড়লে তো...
যাই হোক, প্ল্যান যখন একটা পাওয়া গিয়েছে, তা হলে ঠিক কোন কোন পুজোয় এমনটা হচ্ছে, তা জেনে নেওয়াটা খুব জরুরি। সবাইকে তো একই কথা বলতে হবে।
হোয়াট্স অ্যাপ-এ সুমনার মেসেজ, ওদের বাড়ির কাছে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের সঙ্ঘতীর্থ নাকি এ বার নিজেদের পাড়াকে সাজিয়ে তুলবে সবুজ রঙে। ৪৯তম বর্ষে তাদের ভাবনা ‘সবুজ পাড়ার সবুজ পুজো’। সাবেক সাজের প্রতিমার পাশাপাশি সবুজায়নের বার্তা থাকবে তাদের মণ্ডপের চার দেওয়াল, এমনকী আলোর সাজেও।
সায়নের বাড়ি মুকুন্দপুর। সেখানে মুকুন্দপুর সর্বজনীন দুুর্গোৎসব কমিটি মণ্ডপ সাজাচ্ছে নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছ দিয়ে। তাদের থিম ‘আমি বলছি...’। তবে এই ‘আমি’ কিন্তু কোনও মানুষ নয়। তা হল নানা প্রজাতির লুপ্তপ্রায় ফল-ফুল, গাছপালা ও পশু-পাখি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে যারা প্রায় ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তারাই যেন মানুষকে জানাচ্ছে, পৃথিবী সকলেরই। তারা বাঁচলে বাঁচবে মানুষও।
মিঠি আবার সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করল, শুধু গাছপালা নিয়ে ভাবলে তো হবে না। পরিবেশ দূষণের একটা বড় দিক জলদূষণ। এ শহরে দাঁড়িয়ে যা সবার আগে চোখে পড়ে গঙ্গায়। যার ছবি এ বার চোখে পড়বে শোভাবাজার বেনিয়াটোলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির মণ্ডপে। সেখানে ঢুকলেই চোখে পড়বে নৌকায় জাল হাতে মাঝিরা দাঁড়িয়ে। জলদূষণ রোধের আবেদন জানাচ্ছেন তাঁরা। প্রতিমা দেখতে এগিয়ে যেতে হবে টানেলের মধ্যে দিয়ে। তার দু’দিকে দেওয়ালে থাকবে নানা ছবি। টানেলের ডান দিকে দূষণের কারণ এবং বাঁ দিকে তা রোধের সম্ভাব্য নানা উপায়। টানেল পেরিয়ে দেখা মিলবে প্রতিমার। দেবী এখানে থাকবেন পরিশুদ্ধ গঙ্গায় নৌকার উপরে।
সুমনা আবার বলল, ও নাকি খবর পেয়েছে বেহালার বুড়োশিবতলা জনকল্যাণ সঙ্ঘেরও থিম গঙ্গা নিয়েই। তবে এখানে তা দেখানো হয়েছে অন্য ভাবে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফাইবারের নীল রঙের হাত এখানে নদীর আকার নিয়েছে। ওই হাতের মাধ্যমেই যেন গঙ্গা দেবী দুর্গাকে পরিত্রাণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
শ্রীময়ের মামার বাড়ির পাশে মহামায়াতলা (পূর্ব) মিলনীও ৫৯তম বর্ষে দূষণ মুক্ত পৃথিবী গড়ার বার্তা নিয়েই মণ্ডপ সাজাচ্ছে। ওই মণ্ডপের ভিতর ও বাইরের দেওয়াল তৈরি হচ্ছে ১৬ রকম ফলের খোসা দিয়ে। প্রতিমা এখানে সাবেক।
এ বার টিকলির পালা। ও আবার ওর এক দিদির কাছে এই মাত্র দু’টো পুজোর খবর পেল। নৈনানপাড়া এবং যোগেন্দ্র বসাক রোডের কাছে কর্মী সঙ্ঘে নাকি দেশি-বিদেশি, চেনা-অচেনা নানা গাছের শুকনো ফুল-ফল, ছাল দিয়ে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। আবার বেলঘরিয়ার রানিপার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি এ বার তাদের প্রতিমায় ব্যবহার করছে সীসামুক্ত রং। তাদের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে বাঁশ, দড়ি এবং কাঠ দিয়ে।
কিন্তু লুকিয়ে বেরোনোর কথাটা কিছুতেই ভাল লাগছে না টিকলির। বাবা-মার কাছে ধরা পড়ে যাবে না তো? খানিক পরে রাতে খেতে বসতেই বাবার হঠাৎ প্রশ্ন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে কবে বেরোনো হচ্ছে?’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল টিকলি। প্ল্যানটা বলেই ফেলল সাহস করে (সায়নের অংশটা বাদ দিয়ে)। ভাবল, আগে জানলে এতক্ষণ হোয়াট্স অ্যাপ না ঘেঁটে পড়লে কাজে দিত।