প্রতীকী ছবি।
বাড়িতে দু’বছরের শিশু। মা চিকিৎসার জন্য ভর্তি মানসিক হাসপাতালে। মায়ের মন ব্যাকুল হয় একরত্তি শিশুকন্যার জন্য। ভাই এক বার বলবে, ‘তোর মেয়ে খুব ভাল আছে’। তাতেই শান্তি পাবে মায়ের প্রাণ।
বছর ১৫ ধরে মানসিক আবাসিকের পরিচয় বহন করে চলা মহিলা বোঝেন দিদিরা কেউ তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাবেন না। তবুও কাঁদতে কাঁদতে ফোনে আবদার করেন, ‘‘এক বার দেখে যা না রে!’’ ও পাশ থেকে দিদির গলায় আশ্বাসটুকু পেলেই অফুরান আনন্দ বোনের।
মানসিক রোগ সংক্রান্ত আইন বলছে, রোগীরা চাইলেই যাতে পরিজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন, সেই পরিকাঠামো থাকা উচিত। কিন্তু রাজ্যের মানসিক হাসপাতালগুলিতে সেই সুযোগ নেই। কারণ, হাসপাতালের ল্যান্ডলাইন ফোনের আউটগোয়িং পরিষেবায় রাশ টানা হয়েছে। মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির অভিযোগ তেমনই। সম্প্রতি এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। পরিজনেরা অবশ্য চাইলে ফোন করে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। চিকিৎসক, নার্সেরাও নিজেদের ফোন থেকে বাড়ির লোকের সঙ্গে রোগীদের কথা বলান।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, হাসপাতালের আবাসিকদের ফোন করে পরিজনেরা যাতে কথা বলতে পারেন, সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকা রয়েছে। তবে আবাসিকেরা হাসপাতালের ফোন ব্যবহার করে পরিজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, এমন নির্দেশিকা নেই।
এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য শুক্লা দাসবড়ুয়া বলেন, ‘‘মানসিক হাসপাতালে ভর্তির পরে রোগীর সঙ্গে বাড়ির লোকেরা খুব একটা যোগাযোগ রাখতেই চান না। তাই পরিজনেরা ফোন করবেন, এমন ভাবনা হাস্যকর। চিকিৎসক, নার্স কখন ফোন দেবেন, তা তো তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার উপরে নির্ভর করছে। সেটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হতে পারে না। আমারও যে কেউ আছে সেটা জানান দেয় ফোন।’’
শহরের পাশাপাশি জেলার মানসিক হাসপাতালগুলিরও একই অবস্থা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি জানান, পুরুলিয়া আবাসিকদের জন্য ফোনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, ওই ব্যবস্থা ব্যয়সাপেক্ষ— এই যুক্তি দেখিয়ে প্রস্তাব খারিজ করা হয়। শুক্লা বলেন, ‘‘হয়তো ভাবছে, পাগলের আবার কী এত কথা থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুতোগুলো আঁকড়েই ওঁরা বাঁচতে চান!’’
লুম্বিনী পার্কের সুপার তপন টিকাদারের দাবি, ‘‘আমাদের হাসপাতালে পরিজনদের সঙ্গে রোগীর কথা বলা নিয়ে অসুবিধা নেই। আগে দু’টি ওয়ার্ড ছিল। এখন আটটি ওয়ার্ডে ইনকামিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আউটগোয়িংয়ের জন্য ডাক্তারবাবু, নার্সদের ফোন রয়েছে। তাঁরা অত্যন্ত মানবিক।’’ পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ বলেন, ‘‘আউটগোয়িং কখনওই বন্ধ হয়নি। মাঝে ফোন খারাপ হয়েছিল। ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।’’
সমাজকর্মীদের যুক্তি, যোগাযোগের এই সেতু বিচ্ছিন্ন হলে মানসিক
স্বাস্থ্য পরিষেবাই ধাক্কা খাবে। ছত্তীসগঢ়ের সেন্দ্রি, চেন্নাই, দিল্লি—
কোথাও টেলিফোনে কোপ পড়েনি। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ।
সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘মনোরোগীরা তাঁদের পরিবার থেকে এমনিতেই অদৃশ্য হয়ে যান। ভাল আছি, এইটুকু বলতে পারার সুযোগও যদি না থাকে, তা হলে আবাসিকেরা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবেন। টেলিফোনের অপব্যবহারের জন্য প্রচুর বিল হয় অস্বীকার করছি না। কিন্তু এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে যাতে রোগীরা কথা বলতে পারেন। মানসিক হাসপাতালের আবাসিকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফোন করার মতো ন্যূনতম অধিকারটুকু নিশ্চিত করা হচ্ছে না। জেলের আবাসিকেরাও বাড়িতে ফোন করতে পান। মানসিক হাসপাতালের আবাসিকেরা তা হলে কেন পাবেন না?’’
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যতদূর জানি আবাসিকদের ইচ্ছা হলে বাড়ির পরিজনদের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা রয়েছে। সেই পরিষেবা কোনও কারণে ব্যাহত হয়েছে কি না তা খোঁজ নিয়ে দেখব।’’