উদ্বেগজনক: গঙ্গাসাগরের পুণ্যার্থীদের ভিড় চিন্তায় রেখেছে চিকিৎসকদের। মঙ্গলবার, বাবুঘাটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এক দিকে রাজনীতি, আর এক দিকে ধর্ম। এক দিকে নির্বাচন, আর এক দিকে গঙ্গাসাগরের পুণ্যস্নান। নতুন করে করোনার বাড়বাড়ন্তের সময়ে এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে এ বার এই রাজ্যের মানুষকে ভুগতে হবে ভেবে বিরক্ত লাগছিল। প্রশাসন দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক দলগুলি ঝগড়া করতেই ব্যস্ত! আরও হতাশ হয়ে পড়ছিলাম, প্রশাসনের তরফে গত কয়েক দিনে এ নিয়ে কোনও সদর্থক কথা শুনতে না পাওয়ায়।
বিভ্রান্তির মধ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন, আপাতত দু’মাসের জন্য রাজনৈতিক, ধর্মীয়-সহ সব ধরনের সমাবেশ বন্ধ থাকা উচিত। এমনকি, তিনি যে নির্বাচনও বন্ধ রাখার পক্ষে, প্রকারান্তরে তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মনে হল, অভিষেক সমস্যাটিকে বুঝে সচেতন ভাবে একটা পরিষ্কার মতামত দিয়েছেন। এই গোল গোল কথা বলে এড়িয়ে যাওয়ার যুগে এমন এক জন যখন পরিষ্কার কথা বলছেন, তাঁকে সমর্থন করা উচিত। সেই থেকেই বলেছিলাম, অভিষেক যা বলেছেন, চলুন করে দেখাই। যখন তিনি আমার এই কথাটাকে মান্যতা দিলেন এবং বোঝালেন যে, তাঁরাও চাইছেন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে, তখন মনে হয়, এই ভাবনাটাকে সমর্থন করে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের। শুধু ব্যক্তি অভিষেকই নন, যে কোনও রাজ্যের সরকার আমাদের কাছে সাহায্য চাইলে সব রকম সাহায্য করার জন্য আমরা প্রস্তুত। এটাই হওয়া উচিত আমাদের এই মুহূর্তের প্রথম কাজ। আমার ধারণা, দিনকয়েকের মধ্যেই বৈঠক ডেকে চিকিৎসকদের মতামত এবং ভাবনাচিন্তা জানতে চাওয়া হবে। সেখানে অবশ্যই এ সম্পর্কে জানাব।
কারণ, এমন মাত্রাছাড়া গতিতে বাড়তে থাকা পজ়িটিভিটি রেট নিয়ে চলা অসম্ভব। হাসপাতালের শয্যাও প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে আমরা কত দিন কাটাব? কোনও ব্যক্তিবিশেষের মনে হতেই পারে, এই নতুন স্ট্রেনে তো এখনও পর্যন্ত সে ভাবে ভুগতে হচ্ছে না। সামান্য জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা হচ্ছে! এ সব তো সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অসুখ যখন ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জনেরই হয়, তখন জীবনের অনেক কিছুই বদলে যায়। এই বড় সংখ্যাটা জীবনে বাগড়া দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দিচ্ছে না, এটা আমাদের কাজের জায়গায় তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিচ্ছে। এ ভাবে কত দিন?
এই সমস্যাটা উপলব্ধি করেই শুনছিলাম, ডায়মন্ড হারবারে ভাল কাজ হয়েছে। সেখানে দূরত্ব-বিধি মানার কড়াকড়ি করে, মাস্ক পরানো নিয়ে সতর্ক করে সংক্রমণ অনেকটাই কমিয়ে ফেলা গিয়েছে। ওই এলাকায় যদি এটা হতে পারে, অন্যত্র হবে না কেন? আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা কোনও বিষয় নিয়ে বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে ভাল কোনও কিছুকে গ্রহণ করব না, এটা হতে পারে না। ফলে এখন মনেপ্রাণে যেটা বিশ্বাস করি, সেটাকেই বাস্তবায়িত করার সময়।
কিন্তু এই কড়া বিধি বলবৎ করার ক্ষেত্রে আদালতের তরফে একটু স্পষ্ট দিগ্নির্দেশ আশা করেছিলাম। সব থেকে বড় কথা, শুনানির সময়ে দু’পক্ষ যে ভাবে যুক্তি-তক্কো করেছেন, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ‘সিরিয়াস’ কথাবার্তা হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। আজ শুনছি হরিদ্বার স্নান বন্ধ করেছে, কিন্তু আমরা গঙ্গাসাগরে গিয়ে, হাজার লোক মিলে এখন স্নান করব। দৃশ্যটা ভেবেই একদম ভাল লাগছে না। কোথাও যেন মনে হচ্ছে, আমাদের বিবেক-বুদ্ধি কি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে? কড়া নির্দেশ ছাড়া যেখানে বিধি পালনের উদাহরণ সে ভাবে তৈরি হয় না, সেখানে আরও একটু কড়া হয়ে কি স্নান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া যেত না?
গঙ্গাসাগরের গল্পে আছে না, এখানে সগর রাজার ৬০ হাজার পুত্রের তর্পণ করার জন্য পুরো বিষয়টা শুরু হয়েছিল। সেই ৬০ হাজার সন্তান-সন্ততির মধ্যে এখন কয়েক হাজার বাঙালির নাম না উঠলেই হয়!
(চিকিৎসক)