আমার জন্ম ভাটপাড়ায়। পড়াশোনার প্রথম পাঠ ওখানেই। মাধ্যমিক অমরকৃষ্ণ পাঠশালা থেকে। এগারো-বারো ক্লাস হুগলির মহসিন কলেজে। উচ্চমাধ্যমিকের পর কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে চলে আসি কলকাতায়। গোলপার্কের কেয়াতলা লেন-এ। বাবা রেলে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে কেয়াতলার বাংলোতে থাকা শুরু। এর পর ভর্তি হই খড়দহের রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টেনারি কলেজে। ছোটবেলা কেটেছে মফস্সলে, তার পর শহরে। তাই আমার ভেতরে দুটো কালচারই খুব বেশি করে আছে। আমার মামাবাড়ি ছিল বনগাঁর ঠাকুরনগরে। বছরের মধ্যে চার-পাঁচ মাস ওখানেই কাটত। মা ওখানে বিএড পড়তে যেতেন। আর আমিও মায়ের সঙ্গে চলে যেতাম।
দক্ষিণ কলকাতা একেবারে ঝকঝকে। চারপাশটা খুব স্মার্ট। সেই ৮২ সালের কথা। সে সময় দেখতাম গোলপার্কের মোড়ে জমাটি আড্ডা হত। আমার একটা রেসিং সাইকেল ছিল। সেটা নিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ, লেক এ সব জায়গায় ঘুড়ে বেড়াতাম। সময় পেলে লেকে গিয়ে এক্সারসাইজ করতাম, সাঁতার কাটতাম। মফস্সল থেকে প্রথম কলকাতায় পা রাখলে স্বভাবতই আশেপাশের বন্ধুদের খুব স্মার্ট লাগে। তার একটা বাড়তি আকর্ষণও ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝতে পারি, মফস্সলের বন্ধুদের কালচারের গভীরতা একটু বেশি। আপাতদৃষ্টিতে বলছি, এটা কোনও ধ্রুব সত্যি নয়।
আরও পড়ুন, প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আজও আসে মোচার ঘণ্ট
কলকাতায় থাকতেই প্রথম থিয়েটার করার ইচ্ছে জাগে। আমার গোলপার্কের বন্ধুদের মধ্যে ছিল লাল (সুমন মুখোপাধ্যায়)। ও তখন চেতনাতে। বাবা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের দলে। সে অর্থে লালও তখন ছোট আর আমিও। সে সময় লালের সঙ্গে থিয়েটার নিয়ে একটু আধটু কথা হত। তবে সবটাই গল্পের ছলে। মফস্সলে থাকতেও অনেক নাটক দেখেছি। কলেজে যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলকাতার বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখা শুরু। মনে মনে ভাবতাম কোন দলে যাওয়া যেতে পারে। ঠিক করলাম চেতনাতে যাব। উৎপল দত্তের পিএলটি, বহুরূপী, চর্যাশ্রম, নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শেষে পদাতিক-এ ঢুকলাম। শ্যামানন্দ জালান এর ইনস্টিটিউশনে। এস কৃষ্ণন বলে একজন সাউথ ইন্ডিয়ান ওয়ার্কশপ করাতেন। তখন বিদ্যুৎ নাগ-এর ‘প্রয়াস’ দলে অভিনয় করা শুরু করলাম। অনুভব করতে শুরু করলাম থিয়েটার করতে গেলে পারফর্মিং আর্ট জানাটাও জরুরি। তখনই নাচের তালিম নেওয়া শুরু করি। পদাতিক- এ প্রাথমিক শিক্ষাটা নিয়েছিলাম। পণ্ডিত বিজয় শঙ্করের কাছে কথাকলি। ভারতনাট্যমেও তালিম নিই কলামণ্ডলম থেকে। সাদার্ন অ্যাভিনিউতে ক্রিয়েটিভ ডান্স শিখতাম একজনের কাছে। মার্শাল আর্টের ট্রেনিং নিই। প্রচুর সিনেমা দেখতাম। একই সঙ্গে মাইম শেখা। প্রদীপ ঘোষের কাছে (বাণীচক্র) আবৃত্তি শিখি। এই সময় নিজের থেকে রেওয়াজও শুরু করি। আসলে পারফর্মিং আর্ট-এর যা কিছু শেখা যায় সেটাই কাজে লাগে। তবে সত্যিকারের গানের তালিম শুরু করি চাকরির পর। ফেয়ারলি প্লেসে ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করতাম অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে। এখানে আড়াই বছর চাকরি করি। সেইখানে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, গুণী সেতারবাদক। তার জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তার পরেই নান্দীকার-এ ঢোকা।
গৌতমের চেনা কলকাতা।
ভাটপাড়ায় থাকতে দেখতাম একাঙ্ক নাটক কম্পিটিশন হত। সেই থেকেই থিয়েটারের প্রেমে পড়া। কলকাতায় থাকতাম একেবারে দক্ষিণে। আর নান্দীকার ছিল উত্তর কলকাতায়। ‘এল-নাইন’ দোতলা বাসে শ্যামবাজার যেতাম। উত্তর কলকাতার পুরনো গলি, পুরনো ঘর-বাড়ি দেখে চেনা যেত — দুই কলকাতার মানুষ একেবারে আলাদা। যেমন আড্ডার ধরন আলাদা। কোনও কিছু দেখার ধরনও আলাদা। জায়গা, গা ঘেঁষা বাড়ি, মাঠ, গলিতে খেলা, বাজার, চায়ের দোকান সব কিছুই আলাদা। আমার মতে, উত্তর কলকাতার আন্তরিকতা অনেক বেশি। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতা নিয়ে প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার যাতায়াত করেছি কম করে। কাজেই এক্সট্রিম সাউথ এবং নর্থ এই দুটো জায়গার মানুষের চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্যগুলোও চিনতে শিখেছি।
আমি গোলপার্কে থাকলেও পুরো কাজের সময়টা থাকতাম উত্তর কলকাতায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। চাকরি হওয়ার পর বাস ছেড়ে মোটরবাইকে যেতাম। তার আগে সাইকেল করে প্রয়াস-এ যেতাম অনেক সময়। যখন শিয়ালদহ উড়ালপুল হল, ওর উপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
নান্দীকারে ঢোকার পরে শিখেছিলাম একটা থিয়েটারের ওয়ার্কশপ কেমন হতে পারে। অর্থাৎ ‘মেকিং অব থিয়েটার’। তখন তার ডিটেলিং নিয়ে আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করল। ওই শেখা শুরু। কী করে একটা থিয়েটারের মুহূর্ত তৈরি হয়, এগুলো খুব ইন্টারেস্টিং ছিল আমার কাছে। এই শেখার ফল আজও আমার কাজের মধ্যেই আছে।
আমার যেটা মনে হয় — একজন অভিনেতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল সে যখন অভিনয় করছে, তার উল্টো দিকের মানুষের প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ দর্শকদের ভালবাসার ওপরে তার পাওয়া নির্ভর করে। ‘ফুটবল’ নাটকের অভিনয় থেকে অনুভব করতে শুরু করলাম, নাটকে আমার চরিত্রটা দর্শক খুব ভালবাসছে। এই প্রাপ্তিগুলোই এখনও পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে অভিনয়ের গোড়ার কথা, শুধু এই পাওয়ার জন্য অভিনয় করলে কিন্তু হবে না। অভিনয় করতে গেলে সেই গল্প বা ঘটনার প্রতি তুমি কতটা একাত্ম হচ্ছ, তার সত্যকে কতখানি উপলব্ধি করতে পারছ এবং সেটাকে কী ভাবে প্রকাশ করতে পারছ সেটাই আসল কথা। এই সবটাই আমার যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা। অভিনয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ নিমগ্ন থাকলে এই ঘটনাগুলো ঘটে। রাস্তাঘাটে যখন দেখি থিয়েটার দেখে অচেনা মানুষজন কথা বলে, সেটা বিরাট প্রাপ্তি। যেমন সেই বিরানব্বই-তে ‘ফেরিওলার মৃত্যু’ দেখে এক দর্শকের যে ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল সম্প্রতি শুনলাম সেই অনুভবটা আজও তার মনের মধ্যে আছে। শুনে খুব ভাল লেগেছিল। এই থাকাটাই থিয়েটারের মহান প্রাপ্তি। আবার ছোটরা যখন থিয়েটার দেখে এসে হইহই করে বলে — ভাল লেগেছে, তখন আবার অন্য ধরনের অনুভূতি হয়। মনে মনে বলি, কখনও যেন এই প্রাপ্তির জন্য অহংকার না হয়।
কলকাতার একটা বিরাট প্রাপ্তি — কলকাতায় না এলে আমি থিয়েটার করতে পারতাম না। এত বছরের থিয়েটার জীবন কলকাতায় এসেই হয়েছে। কলকাতা কাজের ক্ষেত্রে খ্যাতি দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, ভালবাসা দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে, রসজ্ঞ মানুষ দিয়েছে। কলকাতা আমাকে আধুনিকতা দিয়েছে, শহরকে চিনতে শিখিয়েছে। নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। একটা শহর কী ভাবে দ্রুত বদলে যায় সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। সেই বদলটা কিন্তু শুধু ওপর ওপর। ভেতরে আবার আত্মাটা যে ঠিক থাকে সেইটাও চিনতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুন, মাঝরাতে এখনও কানে আসে বাঘ-সিংহের ডাক
কলকাতা ধনী সম্প্রদায়কে চিনতে শিখিয়েছে। কলকাতা একইসঙ্গে আমাকে অত্যন্ত ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে পথ চলতে শিখিয়েছে। আবার এই একই কলকাতায় মানুষ কী ভাবে মসৃণ রাস্তা দিয়ে যায় সেটাও চিনতে শিখিয়েছে। চোখের সামনে বড় বড় উড়ালপুল হতে দেখেছি। আগে রাস্তাঘাট কী রকম ছিল তার সবটা মনের ভেতরে আছে। কলকাতার গড়ের মাঠ, মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে দক্ষিণের লেক পর্যন্ত। আবার উত্তর কলকাতার অলিগলি, মণীন্দ্র কলেজের আশপাশ থেকে শুরু করে শ্যামবাজার, শ্যামপুকুর স্ট্রিট সব আমার হাতের তালুর মতো চেনা। আসলে আমার কাজটাই তো নিজের স্বাধীনতার, স্বাধীনভাবে করার। যার অনেকটাই আমার ওপরে নির্ভর করত। যার মধ্যে কল্পনাও মিশে আছে। এই কল্পনাশক্তি পেয়েছিলাম ছোটবেলাতেই। নানা রকম গল্পের বই পড়তাম। আমার সঞ্চয় করা অভিজ্ঞতা, ঘটনা, চেতনাগুলো কাজে লাগাবার সুযোগ এই কলকাতাতে এসেই হয়েছে।
জীবনের পথ তো কখনও মসৃণ থাকে না। এখন তাকালে মনে হয় অনেক পাওয়া। আর এই পাওয়ার রাস্তাটা যন্ত্রণাময়। থিয়েটারের মানুষ বোধ হয় সাধারণত খুব দুঃখী হয়। আসলে থিয়েটার তো তৈরি হয় সম্পর্কের ওপর দিয়ে। সাহিত্যের বা থিয়েটারের গোড়ার কথা সম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে সে জায়গার সম্পর্ক, বস্তুর সম্পর্ক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কাজ করে তার মননে, চিন্তনে, শারীরিক ভাবে একজন ব্যক্তির সঙ্গে একজন ব্যক্তির সম্পর্ক। যেটা নিয়ে থিয়েটারটা চলে। তবে সম্পর্ক মানেই সব সময় মধুর, তা নয়। একটা সুন্দর আনন্দের সম্পর্ক পাওয়ার জন্য অনেকটা পথ যেতে হয়। আসলে প্রত্যেকটা প্রাপ্তি তো একশো শতাংশ নয়। ভেবে দেখতে গেলে, প্রত্যেকটা প্রাপ্তির ভেতরেও অপ্রাপ্তি লুকিয়ে থাকে। থিয়েটারের ক্ষেত্রে দেখেছি যখন খুব মন দিয়ে খুব কঠিন থিয়েটারের কাজ করতে গেছি যার সঙ্গে, তার ভাল লাগছে না। তখন খুব খারাপ লাগত। সেই মুহূর্তে ভাবতাম শুধু তো তার জন্য নয়, থিয়েটারের জন্য কাজ করছি। ঝগড়া বিবাদও হত। তার মধ্য থেকে মনে রেখেছি আমি যদি ঝগড়া, অপমান এ সব মনে রাখি তাহলে চলবে না।
অপ্রাপ্তি নয়, এটাই তো জীবন। কিন্তু তার পরেও এটা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যখন মন্ত্রের মতো মনে রেখেছি এটা কিছু নয়, এ আমার গায়ে লাগবে না। ঠিক যতক্ষণ না পর্যন্ত কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ হচ্ছে, খুব যন্ত্রণাময় একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এ ভাবে ভাবলে কষ্টগুলোকে সামলে নেওয়া যায়। আমি থিয়েটারের ভেতর থেকে এই সত্যিটা বারবার দেখেছি।
এমন অনেক থিয়েটার করেছি যা দেখে দর্শকেরা বলেছে গভীর মননশীল অভিনয়, দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার মতো অভিনয়, কিংবা এটা গৌতমের সেরা কাজ। এই রকম প্রশংসা পাওয়ার পরেও সেই নাটক নিয়ে অনেকে খুব ব্যঙ্গ করে কথা বলেছে। আসলে অভিনেতা হিসেবে খুব প্রশংসাতে ভেসে না যাওয়াই ভাল। আবার খুব খারাপ কথা শুনে ভেঙে পড়লে চলবে না। অর্থাৎ লক্ষ্যটা যেন স্থির থাকে। তবে আমার জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো কখনওই আমাকে লক্ষ্য থেকে টলাতে পারেনি। এভাবেই তো অভিনয়জীবনে তিরিশ বছর পার হয়ে গেল। এটা হয়তো আমার ছোটবেলার শিক্ষা। একজন ভাইয়ের জন্য একজন ভাই কী করতে পারে, চোখের সামনে দেখা। দেড়শো টাকা মাস-মাইনেতে বাবা চব্বিশ জনকে সারা মাস খাওয়াত-পড়াত। আর বাড়ির সকলে ওই ডাল-ভাত খেয়েই সারা দিন কর্মসংস্থামের জন্য লড়তে পারত। রাতে বাড়িতে (ভাটপাড়ায়) ঢালাও বিছানা হত। তাতে লাইন দিয়ে ১২-১৩ জন শুতো। আমিও সবার পাশে শুয়ে পড়তাম। এই যে সম্পর্কের দিক আজকের দিনে কল্পনা করা যায় না। আমি হয়তো সে রকম মানুষ হতে পারিনি। এসব আমার অনুভবে আছে। ছোটবেলার এই ঘটনাগুলো সব সময় আমার মনের মধ্যে ঘোরে। এই সম্পর্কের দিক গুলো আমাকে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও শিখিয়েছে।
মঞ্চে গৌতম।
আমার মধ্যে যদি কোনও পরিবর্তন হয়ে থাকে সেটা সম্পূর্ণ উপরে। মানুষ হিসেবে সচেতন ভাবেই চাই না, যে ভাবে বড় হয়েছি সেটা খুব পাল্টে যাক। কারণ এর ভেতরে অনেক প্রাপ্তি আছে, যেগুলো জীবনের প্রাপ্তি। গ্রামের প্রকৃতি থেকে শুরু করে মফস্সলের অলিগলি, মাস্টারমশাইদের সঙ্গে সম্পর্ক — এগুলো সব সময় মনের মধ্যে জ্যান্ত না থাকলে আমার পক্ষে অভিনয় করা খুব কঠিন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটা কথা মনে পড়ে। আর্টিস্ট সম্পর্কে বলেছেন। যে কোনও আর্টের জোর বা তার সত্য নির্ভর করে অনেকটাই তার ছোটবেলার ওপর। একজন শিল্পীর কাছে তার শৈশব খুব গুরুত্বপূর্ণ এটা খুব মানি। আমি চাই ভেতরের ওই ছেলেটা যেন কখনও পাল্টে না যায়। যে ঝোপের ধারে একটা ফড়িং দেখলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে। অনেকে তাতে বোকা ভাবতে পারে। একটা ঢিল জলে ছুড়লে জলটা যে ভাবে নড়ে, তার দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হই। এগুলো একজন অভিনেতা হিসেবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। কালবৈশাখীতে ঝড়ে আম পড়লে দিদিরা যখন সে আম কুড়োত, সে ছবি আমার মন থেকে কোনও দিনও মুছে যাবে না। ওই অকিঞ্চিৎকর সবুজ কতকগুলো আম কুড়োনোর মধ্যে থেকে যে কী আনন্দ পাওয়া যায়, সেইটা এই কলকাতা শহরে বোঝা দায়। এটা কিন্তু শহরের অপ্রাপ্তির জায়গা।
আমার বাহ্যিক পরিবর্তন বলতে কোনও দিন ভাবতেও পারিনি গাড়ি চালাব। কোনও দিন হয়তো একটা সাইকেলের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কোনও দিনও ভাবতে পেরেছি মলে ঘুরব! সেখানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনার সামর্থ্য হবে আমার। এখনও এগুলো আমার কল্পনার বাইরে। আবার এই যে দেশ বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়, ভাবিওনি ছোটবেলায় ফ্লাইটে করে কোথাও যাব। আমার জীবনে এ সব পরিবর্তন তো এসেছেই। তবে এ সবই বাহ্যিক। আর দক্ষিণ কলকাতায় যে সব পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে গোলপার্কে উড়ালপুল হয়েছে। গড়িয়াহাট থেকে গোলপার্কের রাস্তার মধ্যে অনেকগুলো বইয়ের স্টল ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। সাদার্ন অ্যাভিনিউ আগে অনেক ফাঁকা ছিল। এখন এ সব জায়গায় অনেক দামি দোকান হয়েছে। তবে এগুলো সবই ওপরকার পরিবর্তন। আর একটা পরিবর্তন, বাঙালি কমেছে কলকাতা থেকে। তারা কলকাতা থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে টাকাপয়সার টানাটানির জন্য। অবাঙালিরা বেশি করে ভিড় করছে, কারণ তাদের টাকা আছে।
এখন পৃথিবীর অন্য কোনও শহরে কেউ থাকতে বললে আমি থাকব না। কলকাতা যেমনই হোক, এটা আমার জায়গা। যদিও আমি এসেছি মফস্সল থেকে, এক অর্থে রিফিউজি। সেও তো নতুন জায়গায় তার শেকড় গাড়ে। আমার পুরো যৌবন কেটেছে কলকাতাতে। কাজেই এই জায়গা থেকে অন্য কোথাও গিয়ে আমি কোনও অ্যাসোসিয়েশন পাব না।
চলতে ফিরতে রোজ দেখি কলকাতার বাড়িগুলো কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় — এইখানে কিছু দিন আগেও যে বাড়িটা ছিল সেটা আর নেই! এই মুহূর্তে একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে। যেখানে একটা লোক বাড়ির সঙ্গে কথা বলত। সেই বাড়িটা এক দিন চোখের জলে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘দ্যাখো আমাকে ভেঙে ফেলছে ওরা’। আরেকটা বাড়ি কেঁদে বলছে ‘আমাকে হলুদ রং করে দিল।’ এই যে একটা অবজেক্টের সঙ্গে একটা লোকের সম্পর্ক, এটা তো একজন শিল্পীই ভাবতে পারে। এ সব গল্পে ঠিক আছে, আর সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে হলে পাগলামি! বাস্তব জীবনে যে সব মানুষ এমন কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়, তাদের লোকে পাগল বলে। আমি তো অনেকটা সেই দলেই। অন্য কোথাও কোনও দিন থাকতে বাধ্য হলেও কলকাতার বাড়ি-গাছপালা এ সব আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টানবে। কলকাতা আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে এই শহর তা মনে করে কি না জানি না।
অনুলিখন : পিয়ালী দাস।