ব্র্যান্ড নামে ওষুধ লেখার প্রবণতা ও ডাক্তারদের একাংশের সঙ্গে ওষুধ সংস্থার যোগসাজশের অভিযোগ নিয়ে এর আগে কঠোর হয়েছিল মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)। এ বার তারা দেশ জুড়ে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চিকিৎসকদেরই প্রেসক্রিপশনে ব্র্যান্ড নামের পাশাপাশি বাধ্যতামূলক ভাবে জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশ দিল। গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পরে শেষ পর্যন্ত এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই দেশ জুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে এ নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তোলপাড়। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই এর বিরোধিতা করছেন। তবে সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ (আইএমএ) এমসিআই-এর এই নির্দেশিকাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ, আইএমএ-র যুক্তি, ব্র্যান্ড নাম ও জেনেরিক নাম, দুই-ই পাশাপাশি লেখাটাই বাঞ্ছনীয়। তাতে রোগীদের সুবিধা হবে।
আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কৃষ্ণকুমার অগ্রবাল বলেন, ‘‘ডাক্তারদের তো ব্র্যান্ডের নাম লিখতে বারণ করা হয়নি। বলা হয়েছে, দুই ধরনের নামই উল্লেখ করতে হবে। রোগীরা যা বুঝবেন, সেটা কিনবেন। আমাদের অভিজ্ঞতা, অনেকেই দাম কম হওয়া সত্ত্বেও জেনেরিক নামে ওষুধ কিনতে চান না। তাঁরা ব্র্যান্ডে ভরসা করেন। তাঁরা ব্র্যান্ডের ওষুধই কিনবেন। যাঁরা জেনেরিক কিনতে চান, তাঁরা সেটা কিনবেন।’’
সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল (প্রফেশনাল কনডাক্ট, এথিকস অ্যান্ড এটিকেট) রেগুলেশন্স, ২০০২’-এর সংশোধনী আনা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রত্যেক চিকিৎসককে তাঁর প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সেগুলি লিখতে হবে বড় হরফে। ওষুধের যু্ক্তিসঙ্গত ব্যবহারও যাতে চিকিৎসক নিশ্চিত করেন, জোর দেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারেও।
কিছু দিন আগেই এমসিআই নির্দেশ জারি করে বলেছিল, চিকিৎসকদের আর আঁকাবাঁকা, জড়ানো হরফে প্রেসক্রিপশন লিখলে চলবে না। প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লিখতে হবে বড় হরফে (ক্যাপিটাল লেটারে)। কিন্তু অধিকাংশ ডাক্তারই সেই নির্দেশকে গুরুত্ব দেননি। ফলে এখনও দেশ জুড়ে সেই জড়ানো হাতের লেখার প্রেসক্রিপশনেরই রমরমা। বহু ক্ষেত্রে যে লেখার একবর্ণও বুঝতে পারেন না রোগী বা তাঁর বাড়ির লোকেরা। নির্ভর করতে হয় ওষুধের দোকানের কর্মীদের উপরে। এমসিআই-এর নির্দেশিকা সেই ছবিতে কোনও ফারাক আনতে পারেনি। এ বারের এই নতুন নির্দেশিকা কতটা মানা হয়, সে দিকে তাকিয়ে রয়েছে রোগীদের স্বার্থে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।
জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখার বিরুদ্ধে যে চিকিৎসকেরা সরব হয়েছেন, তাঁদের যুক্তি অনেক। প্রথমত তাঁরা বলছেন, জেনেরিক নামের ওষুধের মান যথাযথ নয়। তাই বহু ক্ষেত্রেই ওষুধে প্রত্যাশিত কাজ হয় না। পাশাপাশি অনেকের যুক্তি, এক-একটি সংস্থা এত ধরনের জেনেরিক ওষুধ এনেছে যে, এক জন চিকিৎসকের পক্ষে সব নাম মাথায় রাখা সম্ভব নয়। সরকারি তরফে জেনেরিক নামের ওষুধের তালিকা তৈরি করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। কলকাতার এক নামী ও প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘জেনেরিক নামের ওষুধ লিখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ক্যানসার, হার্টের অসুখ বা এই ধরনের আরও কিছু অসুখের ক্ষেত্রে বহু সময়েই কম্বিনেশন ড্রাগ দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী হবে, তা স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি।’’
এমসিআই-কর্তারা অবশ্য মনে করছেন, এ সবই নিয়ম না মানার অজুহাত। এমসিআই-এর প্রেসিডেন্ট জয়শ্রীবেন মেটা বলেন, ‘‘ওষুধের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে বহু মানুষের কাছেই চিকিৎসা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখাটা জরুরি। ডাক্তারদের এটা মানতেই হবে।’’ তবে না মানলে কী হবে, সে ব্যাপারে এখনও স্পষ্ট কিছু জানায়নি এমসিআই। কর্তারা জানিয়েছেন, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সে ব্যাপারে ঘোষণা করবেন তাঁরা।
সরকারি চিকিৎসকদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করার কথা বরাবরই। কিন্তু ওষুধ সংস্থাগুলির নানা প্রলোভনে এবং জেনেরিক নামের ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় সেই নির্দেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। এ রাজ্যে ২০০৯ সালে এ বিষয়ে নির্দেশ জারি করেছিলেন বাম সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র। সেই নির্দেশ চিকিৎসক মহলে আদপেই গুরুত্ব পায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ফের বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। ফের জারি হয় নির্দেশ। তবে তাতেও ফলটা আলাদা কিছু হয়নি।
এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁরা জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লিখতেই পারেন। কিন্তু জোগানের ঘাটতি থাকলে রোগীরা সমস্যায় পড়বেন। জেনেরিক নামের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাইরের দোকানে গেলে বহু সময়েই ওষুধ পাওয়া যায় না। কারণ বেশির ভাগ দোকানেই ফার্মাসিস্ট না থাকায় জেনেরিক নাম বুঝে ওষুধ দেওয়ার কেউ থাকেন না। নতুন নিয়মেও তাই রোগীদের ভোগান্তির আশঙ্কাই করছেন তাঁরা।