শান্তির বার্তা আগলে অহিংসার মঞ্জিল

১৯৪৭ সাল। স্বাধীনতা, দেশভাগের অগস্ট প্রায় শেষ। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী তখন এ শহরে। তারই মধ্যে ফের শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৮ ০০:৪৮
Share:

বেলেঘাটার গাঁধী ভবন

১৯৪৭ সাল। স্বাধীনতা, দেশভাগের অগস্ট প্রায় শেষ। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী তখন এ শহরে। তারই মধ্যে ফের শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

Advertisement

এক দিন গাঁধীর সামনেই অন্য ধর্মের পড়শিদের বোমায় প্রাণ গেল দুই যুবকের। বেলেঘাটা অঞ্চলের একদল তরুণ এর পরেই তাঁর কাছে এসে জানালেন, এমন যাতে আর না ঘটে, দু’ধর্মের মানুষই যেন সেখানে থাকতে পারেন, তার দায়িত্ব নেবেন তাঁরাই। তবে অহিংসার পথ তাঁরা বোঝেন না। অস্ত্রের সাহায্যেই পাড়ার নজরদারি করবেন তাঁরা। কিছু ক্ষণ ভেবে সায় দিলেন গাঁধী। কেন? ঘটনার পরদিন যে বিবৃতি তিনি দিলেন, তার সারমর্ম এই— অহিংসার পথ যখন মানবে না সমাজ, তখন হিংসা ব্যবহার হোক কিছু ভাল কাজেও। তাই ওই তরুণদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তিনি বসছেন অনশনে। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন এ শহরেও এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা অহিংসার মাধ্যমে শান্তি আনতে সক্ষম। তিন দিনের সেই অনশন শেষে গাঁধীর

কাছে ভিড় জমেছিল বহু মানুষের। শহরে বন্ধ হয়েছিল দাঙ্গা। গাঁধীর সামনে নিজেদের অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন অনেকে।

Advertisement

বেলেঘাটার যেই জীর্ণপ্রায় বাড়িটিতে সুরাবর্দির সঙ্গে সেই অগস্ট-সেপ্টেম্বরের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন গাঁধী, সেটি এখন ‘গাঁধী ভবন’ নামেই পরিচিত। সারানো হয়েছে দরজা-জানালা, পড়েছে রঙের প্রলেপ। তৈরি হয়েছে মিউজিয়ম। সেই ঐতিহাসিক অনশন ভাঙার দিনে জল খাওয়ার পেয়ালাটি ও তাঁর ব্যবহার করা নানা জিনিসের সঙ্গেই রয়েছে কাচের বাক্সে কিছু অস্ত্র। সেই অস্ত্র, যা তাঁর কাছে জমা পড়েছিল শান্তির প্রতিশ্রুতি হিসেবে।

কাচের বাক্সে রাখা রয়েছে গাঁধীর কাছে সমর্পণ করা অস্ত্রশস্ত্র। ছবি: শৌভিক দে

দেশভাগ, স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব রক্ষায় এই শহরের যে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে, গাঁধীর স্মৃতির সঙ্গে সেই ইতিহাসও মনে করায় এই বাড়ি। সে বছর স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক আগে, ৯ অগস্ট শহরে এলেন গাঁধী। উদ্দেশ্য শান্তিরক্ষার বার্তা ছড়ানো। প্রথমে দিনকয়েক কাটালেন অন্যত্র। তার পরে স্থির করলেন, থাকতে হবে কোনও অস্থির অঞ্চলেই। অর্থাৎ, শহর যখন অশান্ত, তখন তিনি শান্ত-নিরিবিলি এলাকায় থাকতে চান না। বেছে নেওয়া হল দাঙ্গা-জর্জরিত বেলেঘাটা। সেখানেই জনৈক হায়দরি সাহেবের পরিত্যক্ত বাংলো ‘হায়দরি মঞ্জিল’-এ হল তাঁর থাকার ব্যবস্থা। তবে একা থাকবেন না গাঁধী। সঙ্গে থাকবেন সুরাবর্দি সাহেব। যাতে শহরবাসীর কাছে বার্তা পৌঁছয় যে, দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকতে অক্ষম নন।

এমনিতে এ শহরে এলে বসু পরিবারের ১ নম্বর উডবার্ন পার্কের বাড়িতেই উঠতেন গাঁধী। তাঁর মতো করে থাকার ব্যবস্থাও করা ছিল সেখানে। হয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও। সেই সব স্মৃতি এখনও ঘোরে বসু পরিবারের অন্দরে। সুগত বসু যেমন বলছিলেন, ১৯৩৭ সালে এআইসিসি-র সম্মেলনের জন্য শহরে এসে সেই বাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন গাঁধী। খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখা করতে যান সেখানে। কিন্তু সমস্যা হল, গাঁধী ছিলেন তিনতলার ঘরে। তিনি অসুস্থ, তাই নামতে পারবেন না। আর কবি তখন তিনতলায় ওঠার মতো শারীরিক ভাবে শক্ত নন। শেষে কবিকে একটি চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তিনতলায়। চেয়ারটি ধরেছিলেন যে চার জন, তাঁদের নাম— শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু এবং মহাদেব দেশাই। গাঁধী এলে সেই বাড়ির ছাদে নিয়মিত বসত প্রার্থনাসভাও, জানালেন সুগতবাবু।

তবু বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলই ‘গাঁধী ভবন’ বলে পরিচয় লাভ করেছে সেখানকার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে।

তবে হায়দরি মঞ্জিল এক দিনে গাঁধী ভবন হয়ে ওঠেনি। সেই বছর ৭ সেপ্টেম্বর গাঁধী কলকাতা ছাড়লেন। চলে গেলেন বিখ্যাত নোয়াখালি সফরে। তার পরে বিহার। সেই থেকে আবার বেশ অনেক দিন পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে ছিল বাড়িটি। ধীরে ধীরে ওই বাড়ির ইতিহাস রক্ষায় এগিয়ে আসেন স্থানীয় কয়েক জন মানুষ। গড়ে ওঠে ‘গাঁধী শতবার্ষিকী কমিটি’, ‘পূর্ব কলকাতা গাঁধী স্মারক সমিতি’, ‘বাপুজি স্মারক সমিতি’ও। এগিয়ে আসে সরকারও।

বেলেঘাটার সেই অঞ্চলে গেলে এখন রীতিমতো ঝকঝকে গাঁধী ভবনের দেখা মেলে। আগামী ২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে হেরিটেজ তকমা পাবে এই ভবনটিই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement