উত্তাল: স্কুলের সিদ্ধান্ত কানে যেতেই গর্জে উঠল ভিড়। জি ডি বিড়লার গেটে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
ঘরে ময়লা জমেছে, সেই ঘর আগে পরিষ্কার হোক, তার পরে সেই ঘর মানে স্কুলে বাচ্চাকে পাঠাবেন। এমনই অবস্থান প্রথমে ছিল তাঁদের অনেকের। কিন্তু স্কুলের মধ্যে চার বছরের ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগকে কেন্দ্র করে জি ডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশন কর্তৃপক্ষই সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সোমবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ রাখার ঘোষণা করলেন। রবিবার সকালে সে কথা জানার পরেই ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের বক্তব্য বদলে গেল। তাঁরা অগ্রিম তিন মাসের বেতন দিয়েছেন, সেখানে কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ করেন কী করে, এমন প্রশ্নও তুললেন বহু অভিভাবক।
নিজেদের ফোরাম গঠন ও ক্ষোভ প্রকাশের জন্য রবিবার সকাল ৯টায় রানিকুঠির কাছে ওই বেসরকারি স্কুলের সামনে সভার কাজ শুরু করেন অভিভাবকেরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পৌঁছয়, স্কুল কর্তৃপক্ষ সোমবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জি ডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশন বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছেন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত, স্কুলের অধ্যক্ষের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সোমবার, ৪ ডিসেম্বর থেকে স্কুলের জুনিয়র ও সিনিয়র দু’টি শাখাই বন্ধ থাকবে পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়া পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: ‘বোনের’ হেনস্থায় সরব দিদিরা
স্কুলটি যে সংস্থার অধীনে রয়েছে তার মুখপাত্র সুভাষ মোহান্তি জানান, সকলের নিরাপত্তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। শুক্রবার যে ভাবে অভিভাবকেরা গভীর রাত পর্যন্ত শিক্ষিকাদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন, তাতে সমস্যার সমাধান না হওয়ার আগে স্কুল খুললে শিক্ষিকাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বারবার আলোচনার জন্য আবেদন করলেও অভিভাবকেরা প্রথম থেকেই চাইছিলেন স্কুল বন্ধ হয়ে যাক। সে কারণেই এই করার সিদ্ধান্ত নিতে হল। পরীক্ষার্থীরা অসুবিধায় পড়বেই। কিন্তু আমরা আর কতটা করতে পারি? পুলিশ তো সকলকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে পারবে না।’’
এ দিকে, স্কুল বন্ধের এমন খবর ছড়িয়ে পড়তেই উদ্বেগ ছড়ায় অভিভাবকদের মধ্যে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাসের পরীক্ষা চলছে। সূচি অনুযায়ী, আজ, সোমবারও পরীক্ষা রয়েছে। ২২ ডিসেম্বর থেকে দশম শ্রেণির প্রি-বোর্ড পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। দ্বাদশ শ্রেণির প্রি-বোর্ড পরীক্ষা হবে জানুয়ারিতে। তার প্রস্তুতি হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ক্লাস হবে বলে ঠিক ছিল। কারণ, বেশ কিছু বিষয়ের সিলেবাস এখনও শেষ হয়নি।
দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার এক ছাত্রীর বাবা সমীরণ বৈরাগ্য বলেন, ‘‘প্রি-বোর্ড পরীক্ষার আগে এই মাসের ১০ দিনের ক্লাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব কোর্স এখনও শেষ হয়নি। কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ করে দেওয়ায় পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হল।’’ ওই অভিভাবকের আরও বক্তব্য, অবশ্যই স্কুলে ছাত্রীদের নিরাপত্তা অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে। দু’-চার দিন বন্ধ থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু এর বেশি বন্ধ থাকলে সমস্যা।
আজ, সোমবার অষ্টম শ্রেণির ফিজিক্স পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। ওই ক্লাসের এক ছাত্রীর বাবার কথায়, ‘‘সব ছাত্রী স্কুলে ঢুকবে, যাদের পরীক্ষা আছে, সবাই দেবে। আমরা, মানে অভিভাবকদের ফোরাম কোনও বাধা দেব না।’’ পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা সোমবার ছিল না। কিন্তু ওই ক্লাসের এক ছাত্রীর বাবা বললেন, ‘‘স্কুল বন্ধ থাকুক, এমন আমরা চাইছি না। আমরা শুধু ছাত্রীদের নিরাপত্তা চাইছি। ফোরাম স্কুল বন্ধ হতে দেবে না।’’
এ দিন সকাল ৯টায় স্কুলের সামনে শুরু হওয়া সভায় যদিও নির্যাতিতার বাবা বলেছিলেন, ‘‘৩০ নভেম্বর আমার বাচ্চার সঙ্গে ও ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বরে আর একটি শিশুর সঙ্গে স্কুলের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটল কেন, প্রিন্সিপ্যালকে তার জবাবদিহি করতে হবে। না হলে এই স্কুল প্রয়োজনে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।’’ সে সময়ে হাততালিও পড়েছিল।
স্কুলের অভিভাবকদের অধিকাংশ মনে করছেন, তাঁদের বাড়তি চাপে ফেলতেই স্কুল বন্ধ করার নোটিস দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। যাতে উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের অভিভাবকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে কিছু দিনের মধ্যে এবং যাদের পরীক্ষা নেই, সেই ছাত্রীদের বাবা-মায়ের সঙ্গে সংঘাতে নামেন। স্কুল বন্ধের ঘোষণা তাঁদের মধ্যে বিভাজন আনার কৌশল বলেই মনে করছেন অভিভাবক ফোরামের সদস্যেরা। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, তিন বছর আগেও দু’দিন স্কুল বন্ধ রেখে অভিভাবকদের মধ্যে দু’টি গোষ্ঠী তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তা মাথায় রেখেই অভিভাবকেরা এ বার একতা ধরে রাখতে স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন। তবে সূত্রের খবর, দিনভর অভিভাবকদের তরফে বহু ই-মেল, ফোন ও এসএমএসে স্কুল বন্ধ না করার আর্জিতে কিছুটা হলেও নরম হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। রাতে তাঁরা জানিয়েছেন, ফের ভেবে দেখবেন, এ বিষয়ে কী করা যায়।