রমা হালদার
জঙ্গলের মধ্যে আচমকাই বিগড়ে গিয়েছিল তাঁদের গাড়ি। কোনও কিছু না বলে চালক চম্পট দিলেও ছাড়ার পাত্র ছিলেন না দুই যুবক। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের পথে ট্রাক দাঁড় করিয়ে তাতে চেপেই চালকের পিছু নিয়ে তাঁকে পাকড়াও করেছিলেন তাঁরা!
প্রায় ৩৯ বছর আগে মধ্যপ্রদেশের রাহাতগড় জঙ্গলে সেই ‘অ্যাডভেঞ্চারের’ দুই নায়কের এক জন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাল্যবন্ধুর নোবেল জয়ের আনন্দ প্রকাশের মাঝে এত বছর আগের স্মৃতি মনে পড়লে আজও হেসে ফেলেন জঙ্গল-পথের আর এক নায়ক, বর্তমানে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক উজ্জয়ন ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘ওই সব দিন কখনও ভোলা যায়! অভিজিৎ যে বছর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেল, তার আগের বছরেই দু’জনে বেড়াতে গিয়েছিলাম।’’
রোগাটে, লম্বা চেহারার বন্ধুকে আজও মনে রেখেছেন মহানির্বাণ রোডের মুদির দোকানের মালিক গণেশ হাজরা। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘‘ওঁর বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি। ছুটির দিন দুপুরে পাঁচ-ছ’জন মিলে গলিতে ইট সাজিয়ে উইকেট বানিয়ে ক্রিকেট খেলতাম।’’ সকলে মিলে চাঁদা তুলে কেনা ব্যাট দিয়েই চার-ছয় হাঁকাতেন অভিজিৎবাবু। মাঝেমধ্যে তাঁকে বোল্ড করে যত না আনন্দ পেয়েছিলেন, এ দিন তাঁর নোবেল জয়ের খবরে কয়েক গুণ বেশি আনন্দ ও গর্ব হচ্ছে বলেই জানালেন গণেশবাবু। বললেন, ‘‘এ পাড়ায় যখন থাকতেন, বিদেশ থেকে বাড়ি এলে আমার দোকানে আসতেন। কিছু ক্ষণ কথা হত।’’
৩১, মহানির্বাণ রোডের বাড়িটির মালিকানা অবশ্য বদলেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। বাড়ি বিক্রি করে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার চলে গিয়েছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের আবাসনে। সেখানেই অভিজিৎবাবুর মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখাশোনা করেন রমা হালদার। বিদেশ থেকে কয়েক দিনের জন্য ‘বড়দা’ বাড়ি এলে রমাই তাঁকে কালো জিরে-ফোড়ন দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল, আলু-পোস্ত আর আম-কাতলা রেঁধে খাওয়ান। খাদ্যরসিক অভিজিৎবাবুও ভালবাসেন রান্না করতে। রাঁধেন মাংসের পদ।
অভিজিৎবাবুর সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটের প্রতিটি ঘরে সাজানো বই। উজ্জয়নবাবু বলেন, ‘‘প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস ওর। প্রতিটি বই মগজে যেন কপি করে রাখতে পারে। ওকে জিজ্ঞাসা করলে প্রতিটি বইয়ের বিষয়বস্তু, সারমর্ম গড়গড় করে বলে দিতে পারে।’’ অভিজিৎবাবু আমেরিকায় পাড়ি দিলেও স্কুলের বন্ধুদের ৮-১০ জনের দল আজও একই রকম রয়ে গিয়েছে বলে জানালেন পঞ্চম শ্রেণি থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করা বন্ধু বাপ্পা সেন। বললেন, ‘‘আগে চিঠিতে যোগাযোগ থাকত ওঁর সঙ্গে। এখন ই-মেলে যোগাযোগ রাখি।’’
অভিজিৎবাবুর নোবেল জয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত তাঁর কলকাতার প্রতিবেশীরাও। এক প্রতিবেশী গীতা পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘পুওর ইকনমিক্স বইটা নির্মলাদেবী আমায় পড়তে দিয়েছিলেন। বইটা পড়ে ভাল লেগেছে বলায়, অভিজিৎ লাজুক হেসেছিলেন।’’ ক্রিকেট ছাড়াও সাঁতার কাটতে পছন্দ করেন ঝিমা (অভিজিৎবাবুর ডাকনাম)। বন্ধুদের ‘ঝিমা’ এখনও কলকাতায় এসে খেলতে যান টেবিল টেনিস। আর ড্রয়িংরুমে বসে চুটিয়ে আড্ডা দেন বন্ধুদের সঙ্গে।
প্রতি বারের মতোই এ বারও ‘বড়দা’কে আনতে কবে তিনি বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে যাবেন, তারই দিন গুনছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে অভিজিৎবাবুদের বাড়ির গাড়িচালক হরিশ সাউ। আর নোবেলজয়ীর বন্ধুরা অপেক্ষায় রয়েছেন, কবে আসবে সেই টেলিফোন—‘‘আমি কলকাতায় এসে গিয়েছি!’’