কলকাতার ফরাসি কনস্যুলেটে বোজোলে ন্যুভো সুরা উত্সব। ছবি: সুমন বল্লভ।
মদ্যপান নিয়ে খানিক ‘কিন্তু-কিন্তু’ এখনও বহাল এ দেশে। তবু সূক্ষ্ম মোচড়ের অভিজাত সুরাকে নিছকই মদ বলাটা যে অনুচিত তা বলে গিয়েছেন গত শতকের ডাকসাইটে আড্ডাধারী বাঙালি শাঁটুলবাবু ওরফে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। যাঁর মতে, উচ্চাঙ্গের ওয়াইনকে মদ বলাটা বিদূষী, উজ্জ্বল নারীকে একটি অপশব্দে ডাকার মতোই ঘোর অবিচার।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতার ফরাসি কনসাল জেনারেল দামিয়েন সৈয়দ যেন তার থেকেও এক কাঠি বাড়িয়ে বললেন। ‘‘ফ্রান্সের কাছে সুরা মানে সংস্কৃতি, পরম্পরা। মৃত্যুকে জয় করা অবিনাশ জীবনেরও প্রতীক।’’ প্যারিসে পর পর আত্মঘাতী হামলার বর্ষপূর্তি হয়েছে মাত্র
ক’দিন আগে। ফ্রান্সের বচ্ছরকার জাতীয় সুরা উৎসবের স্বাস্থ্য কামনার মুহূর্তটিতে কলকাতার আসরে সেই দগদগে ঘায়ের কথা মনে করিয়েছেন সৈয়দ। এবং পেয়ালা ভরা, গাঢ় লাল আঙুরের রক্ত তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘জীবনের এই উৎসব মানে সঙ্কীর্ণ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘাড় সোজা রাখারও নির্ঘোষ।’’
নোট-নাকাল এ দেশে সুরা উৎসবে মেতে ওঠার পক্ষে বড় সুখের বা আনন্দের সময় নয় এখন। তবু এ বারই প্রথম ফ্রান্সের জাতীয় সুরা উৎসবের ছোঁয়াচ লাগল এ শহরে। গত কয়েক বছরে ফ্রান্সের সঙ্গে বেরাদরি আরও গাঢ় হওয়ার বার্তাও দিয়ে গেল এই উৎসব। সাম্প্রতিক অতীতে বছর বছর এ দেশের বিভিন্ন শহরে ফরাসি সংস্কৃতির সৌরভ ছ়ড়াচ্ছে ‘বঁজু ইন্ডিয়া’ উৎসব। আবার ফ্রান্সের শহরে-শহরেও একই ভাবে আসর জমিয়েছে ‘নমস্তে ফ্রান্স’-এর আবেশ। কনসাল জেনারেল বলছিলেন, ফ্রান্সে ভাষা শিক্ষার টানে পর্যটন প্রসারেও নতুন মোবাইল অ্যাপ ‘ইমার্সিও ফ্রান্স’ (immersion france) সম্প্রতি চালু হয়েছে। ফরাসি কনস্যুলেটের আধিকারিকেরা বলছিলেন, ইদানীং পূর্ব ভারত তথা কলকাতাতেও বেশ কয়েকটি নতুন ফরাসি সংস্থা বাণিজ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে কাজ করতে ডানা মেলেছে। স্মার্ট সিটি প্রকল্পে কলকাতায় নানা কিসিমের পরিকাঠামো নির্মাণে ফরাসি সহযোগিতা নিয়ে কথা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফরাসি কনস্যুলেট ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্পর্কের সেতু গড়ায় ইন্ধন জুগিয়েছেন। ফ্রান্সের জাতীয় সুরা উৎসবের এই কলকাতা-সংস্করণও যেন জমিয়ে তুলল পারস্পরিক কূটনীতির সেই সংলাপই।
নভেম্বরের তৃতীয় বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁতেই ফ্রান্স মেতে ওঠে বচ্ছরকার ‘বোজোলে নুভো’ উৎসব নিয়ে। লিয়ঁ শহরের উত্তরে, আল্পস পাহাড়ের কোলে বোজোলে এলাকার আঙুরখেতের প্রথম ফসলেই এই ওয়াইনের জন্ম। মোটে কয়েক সপ্তাহ আগে খেত থেকে তোলা বেগনিরঙা গামে-আঙুরে জন্ম নেয় বছরের প্রথম ওয়াইন। এর পরে ধাপে ধাপে অন্য সব বিচিত্র দ্রাক্ষারসও বাজারে আসে। কনস্যুলেটের রসিক ফরাসিরা বলছিলেন, ওয়াইন-বিলাসের এ যেন উলটপুরাণ। অন্য সব ওয়াইন বছরের পর বছর, এমনকী দশক পার করেও মজিয়ে চাখা দস্তুর। কিন্তু, মরসুমের প্রথম সুরা বোজোলে নুভো আস্বাদের নিয়ম অন্য। সাধারণত বছর পার হলে, এ আর পানোপযোগী থাকে না।
কষাটে ভাব কম। টক-টক স্বাদ। রসিকরা বলেন, মাংসটাংসের থেকে বরং হাল্কা চিজ-রুটির সঙ্গতেই এ জমে ভাল। কলকাতার এক নামজাদা ওয়াইন ইমপোর্টার সংস্থার কর্তা শরৎ পারসান বললেন, ‘‘বোজোলে নুভোর মতো নাজুক ওয়াইন এ দেশে আনা মহা ঝকমারি। এ তো গড়িমসি করে আনা যাবে না। নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটাতে সময় লাগে।’’ কনস্যুলেট কর্তারা বলছিলেন, এ বারও ফ্রান্স থেকে কলকাতার পথে দোহায় আটকে ছিল এই সুরা। শেষ মুহূর্ত অবধি তাকে পাওয়া যাবে কি না, অনিশ্চয়তা ছিল।
এ শহরে ফ্রান্সের প্রাক্তন ট্রেড কমিশনার, চার দশকের কলকাতাবাসী প্রৌঢ়া মারি ক্লদ অলিভিয়ের এই দেশি স্বাদ পেয়ে ভারী খুশি। ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘‘ঠিক যেন শীতের নলেনগুড় বা গরমের ঠিক আগে নিমপাতা ভাজা খাওয়ার আমেজ। সময়ের স্বাদটা সময়ে পেলে কী যে ভাল লাগে!’’ প্রথম নবান্নের ফসল ঘরে তোলার বিস্মৃত উৎসব নিয়েও ফিসফিস শোনা গেল শহুরে আবহে। মালুম হল, রসিকজনের থেকেও এ যেন আমনাগরিকের সুরা। নিছকই স্বাদ-মহিমা নয়, যার পরতে পরতে মিশে আছে জাতীয় সংস্কৃতি।