শেষমেশ ওলা-উবেরের মতো লাক্সারি ট্যাক্সির পারমিট দেওয়ার প্রক্রিয়াই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিল রাজ্য পরিবহণ দফতর।
কেন? কারণ, পরিবহণ দফতরের তাবড় কর্তাদের আশঙ্কা একটাই। অতিরিক্ত গাড়ির ভিড়ে যদি ওলা-উবেরের মতো লাক্সারি ট্যাক্সির ব্যবসা ফিকে হতে শুরু করে! আর তার জেরে হাজার-হাজার বেকার যুবক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের ‘গতিধারা’ প্রকল্পে গাড়ি নামিয়ে শেষে মুখ থুবড়ে পড়েন!
তাই শুধু লাক্সারি ট্যাক্সির পারমিট বিলি বন্ধ করাই নয়, ‘গতিধারা’ প্রকল্পে আবেদনকারীদের লাক্সারি ট্যাক্সির বদলে ‘অন্য গাড়ি’ কেনার উপরেও বাড়তি উৎসাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবহণ দফতরের কর্তারা। প্রথম ধাপে গতিধারা প্রকল্পে পাঁচ হাজার আবেদনকারীকে সর্বাধিক এক লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। প্রয়োজনে, ওই সংখ্যা বাড়তেও পারে। নবান্ন সূত্রের খবর, আপাতত তাই বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন করে লাক্সারি ট্যাক্সির আবেদন গ্রহণ করার প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ, পরিবহণ-কর্তাদের বক্তব্য, ‘‘সরকারি সাহায্যে গাড়ি নামিয়ে শেষমেশ ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়লে আজ-বাদে-কাল তা ব্যুমেরাং হতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই আগাম সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে।’’
গত বছরের মাঝামাঝি উবের, মেরুর মতো লাক্সারি ট্যাক্সির রমরমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হলুদ বা নীল-সাদা ট্যাক্সির জনপ্রিয়তা কমছিল। বাড়ছিল ম্যাঙ্গো লেনে রাজ্য পরিবহণের সদর দফতরের সামনে লাক্সারি ট্যাক্সির পারমিট নিতে বেকার যুবকদের লাইন। আগে যেখানে সপ্তাহে শ’খানেক লাক্সারি ট্যাক্সির আবেদন জমা পড়ত, সেখানে গত বছর থেকে এক লাফে ওই সংখ্যা বেড়ে হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পরিবহণ কর্তাদের ব্যাখ্যা, ট্যাক্সিচালকদের দাদাগিরি, মর্জিমতো যাওয়ার প্রবণতাই ওলা-উবেরের মতো সংস্থার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, ওলা-উবের মাসিক যে টাকা দিচ্ছে, তা-ও কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যুবকদের ওই ব্যবসায় নামতে যথেষ্ট উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে দাবি গাড়ির চালকদের। লাভজনক হওয়ার কারণে গাড়ির ঋণদাতারাও লাক্সারি ট্যাক্সিতে বিনিয়োগে উৎসাহ দিচ্ছেন।
পরিবহণ দফতরের কর্তাদের একাংশের দাবি, ‘‘এই প্রবণতা চিরকাল থাকবে না। তা ছাড়া, চাহিদার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেলে সাধারণ পাটিগণিতের নিয়ম মেনেই লাভের পরিমাণ কমবে। ইতিমধ্যেই, ওলা-উবেরে আয়ের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। এই অবস্থায় ওলা, উবেরের ব্যবসা চিরকাল লাভজনকও থাকবে না।’’ আর এখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন রাজ্য পরিবহণ দফতরের কর্তারা। এক পরিবহণ কর্তার কথায়, ‘‘বেকার যুবকেরা লক্ষ-লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে লাভের কড়ি গুনতে না পারলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। সারদায় টাকা ডুবে যাওয়ার পরে অনেকেই যেমন আত্মহত্যা করেছেন, সে রকম ঘটতে পারে এখানেও। তখন তার দায় গিয়ে পড়বে সরকারের উপরে। কারণ, এখন গতিধারা প্রকল্পের টাকাতেও লাক্সারি ট্যাক্সির নেওয়ার উৎসাহই বেশি।’’ সে কারণেই আপাতত লাক্সারি ট্যাক্সির পারমিট দেওয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণ আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের পরিবহণ দফতর।
তবে এর পিছনে অন্য ‘কারণ’ও রয়েছে বলে দাবি পরিবহণ কর্তাদের একটি অংশের। ওই অংশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘কলকাতায় প্রয়োজনের নিরিখে রাস্তার পরিমাণ কম। তার উপরে যে হারে ব্যাক্তিগত গাড়ি ও লাক্সারি ট্যাক্সির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে কলকাতা শহরে গত ছ’মাসেই যানজট বেড়ে গিয়েছে।’’ ওই কর্তার দাবি, সম্প্রতি এ বিষয়ে পরিবহণ দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন খোদ কলকাতা পুলিশের কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থও। এর পরেই লাক্সারি ট্যাক্সির ঢালাও পারমিট বিলির উপরে নিয়ন্ত্রণ আনার সিদ্ধান্ত। ওই কর্তা আরও বলেন, ‘‘ভোট রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কলকাতা ছাড়াও জেলা থেকে গতিধারা প্রকল্পে আবেদন নেওয়ার ব্যাপারে একই রকম জোর দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে লাক্সারি ট্যাক্সি না নিয়ে যাঁরা মিনিডর, বাস-সহ অন্য যানবাহন নিতে চাইছেন, তাঁদের বেশি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।’’