বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউ এমব্যাসি রেস্তরাঁ। নিজস্ব চিত্র
এক মাসেই সব পাল্টে গিয়েছে। বিশপ হাউসের পাশের ঠিকানাটা তালাবন্ধ। পুরনো নামের চিহ্নও মুছে সাফ। শুধু লাল হরফে কয়েকটা চিনা অক্ষর অটুট। যা দেখে থমকে দাঁড়ায় নন্দন, ভিক্টোরিয়ায় পথচলতি কলকাতা। লেখাটার মানে না বুঝলেও বুকে ধাক্কা লাগে।
তরুণ প্রেমিক জুটির খেদ, ইশ! এত সস্তায় এমন মুখরোচক চাইনিজ সহজে মিলবে না শহরটায়। গ্রেভি নুডলস, প্রন বল, চটপটা চিলি পর্কের জন্য প্রাণ আনচান মাঝবয়সিদেরও। অর্ধশতকের পুরনো নিউ এমব্যাসি রেস্তরাঁটি অনেকেরই চিনা খানা চেনাজানার রোমাঞ্চে মিশে ছিল। এই ‘অপমৃত্যু’ বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন তাঁরা।
দুর্গাপুজো, রবীন্দ্রগান, সন্দেশ-রসগোল্লার মতো চিনে খাবারও কলকাতার একটি বিশেষ পরিচয়। শহরের সাবেক চিনা রান্নার
শৈলী চাখতেও মুখিয়ে থাকেন দেশবিদেশের রন্ধনশিল্পী, ভোজ-রসিকেরা। কিন্তু কলকাতায় চিনাদের নিজস্ব চাইনিজ রেস্তরাঁগুলির
সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে কমছে। সে কালের ওয়ালডর্ফ, পিপিং বাদই দেওয়া গেল, গত দু’-তিন বছরে ট্যাংরায়
ঝাঁপ গুটিয়েছে চুং, এভারগ্রিন, ফ্লোরা, কিম লি লয়েরা। নিউ এমব্যাসির ম্যানেজার ফ্রান্সিস ইয়েহর কথায়, ‘‘বাড়িওয়ালার অন্য কিছু করার পরিকল্পনা আছে। উনি ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলে রেস্তরাঁর মালিক,
আমার কাকা স্যামসাং রাজি হয়ে গেলেন। কাকা এখন কানাডায়।’’ সল্টলেকে ফ্রান্সিসের আর এক কাকা জেমসের রেস্তরাঁ সেলিব্রেশনও পাততাড়ি গুটিয়েছে। ফ্রান্সিস বলছেন, “আমার বাবারা সাত ভাই। দার্জিলিংয়েও হোটেল ছিল আমাদের। এখন কেউই দেশে নেই।’’ ফ্রান্সিসও দুবাইয়ে রেস্তরাঁর চাকরিতে যেতে পা বাড়িয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এ শহরে ৩০-৪০ হাজার চিনা থাকতেন। “সংখ্যাটা কমে এখন হাজার তিনেক”, বলছিলেন চাইনিজ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের
সভাপতি বিনি ল। এ শহরের চিনারা অনেকেই জীবনে চিন দেখেননি। কিন্তু ভারত, চিন উত্থানপতনের আঁচ লাগে তাঁদের গায়েও। সেই সঙ্গে কলকাতায় সীমিত কাজের সুযোগও শহর ছাড়ার কারণ। ট্যাংরার
দাপুটে রেস্তরাঁ কর্ত্রী মনিকা লিউ অবশ্য মনে করেন, “কলকাতায় পানশালা চালাতে সরকারকে পাঁচ লক্ষ টাকা কর দিতে হয়। এই চাপেই ট্যাংরার রেস্তরাঁগুলি বন্ধ।” তবে প্রোমোটারির গ্রাসেও অনেক চিনা ঠিকানা মুছে যাচ্ছে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পুরনো রেস্তরাঁ হাউহুয়া লর্ডসের মোড়ে দ্বিতীয়
ইনিংস শুরু করেও রণে ভঙ্গ দিয়েছে। তাদের পুরনো শেফদের বয়স হয়েছে। আবার, অতিমারিতে দু’বছর বন্ধ থাকলেও ট্যাংরার ঐতিহ্যশালী
কিম ফা কিন্তু ফিরে এসেছে।
কর্ণধার শে উই টং ৭২ বছরে ফের হেঁশেল সামলাচ্ছেন। খরচ কমাতে পানশালা বন্ধ করে দিয়েছেন
তিনি। নবীন প্রজন্ম দেশান্তরে। বয়সের ভারে অনেক রেস্তরাঁকর্তাই
এখন ক্লান্ত। প্রশ্ন ওঠে, ইনট্যানজিবল হেরিটেজ বা আবহমান ঐতিহ্য হিসেবে
চিনা খানার জন্য কেন মায়া
নেই শহরের ঐতিহ্য বিশারদদের? বার্বিকিউ রেস্তরাঁর কর্ণধার রাজীব কোঠারি মনে করেন, ‘‘বাঙালি, বিহারি শেফরাও কিন্তু চিনা রান্না শিখে নিয়েছেন। কলকাতার চিনা খানার ঐতিহ্য তাই পুরোপুরি কখনওই
মুছবে না।’’