বিভাস ঘোষ।
কী কী উপহার তার চাই-ই চাই, ক’দিন ধরে উঠতে-বসতে বাবা-মায়ের কাছে সমানে তার তালিকা পেশ করছিল আট বছরের ছেলেটা। তার আবদারের তালিকায় কখনও থাকত বন্দুক, কখনও বা বল। ৫ অক্টোবর, শুক্রবার যে তার জন্মদিন!
মঙ্গলবার সকালে মায়ের হাত ধরে হাঁটার সময়েও উপহারের ফর্দ গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছিল তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া বিভাস ঘোষ। মা সীতা ঘোষ যেখানে পরিচারিকার কাজ করেন, দমদম কাজিপাড়া মোড়ের সেই ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়েও চলছিল মা-ছেলের কথাবার্তা। আচমকাই বিকট শব্দ। ধোঁয়ায় ভরে গেল চতুর্দিক। ধোঁয়া সরতে দেখা গেল, মায়ের হাত ছিটকে রাস্তার এক ধারে পড়ে আছে ছোট্ট বিভাস। বিস্ফোরণে ঝলসে গিয়েছে তার মুখের বাঁ দিক, গলা, বুক। দুই পা থেকে বেরিয়ে এসেছে মাংসের টুকরো। পড়ে আছেন সীতাদেবীও। তাঁরও দু’হাত, কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঝলসে গিয়েছে।
পড়শিরা মা-ছেলেকে তড়িঘড়ি দু’টি অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে হাসপাতালে ছোটেন। স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতাল, পার্ক সার্কাস ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ ঘুরে পৌনে ১২টা নাগাদ এসএসকেএম হাসপাতালে পৌঁছয় বিভাস। সেখানেই বার্ন ইউনিটে মিনিট কুড়ি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে হার হয় তার।
কুলপি থেকে পিজি-তে ছুটে এসেছেন বিভাসের কাকা দীপঞ্জয় ঘোষ। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘তিন দিন পরে ওর জন্মদিন। ভিডিয়ো গেম চেয়েছিল। অনলাইনে অর্ডার দিয়েছি। খেলনাটা তো আসবে, কিন্তু খেলবে কে?’’ দীপঞ্জয় জানান, তাঁর দাদা জন্মেজয় ঘোষ স্ত্রী সীতা, দুই ছেলে বিকাশ আর বিভাস ওরফে বিল্টুকে নিয়ে ১০ বছর ধরে আছেন দমদমের অর্জুনপুর খালপাড়ে ভাড়াবাড়িতে। কাজ করেন মতিঝিল এলাকার একটি মিষ্টির দোকানে। সীতাদেবী কয়েকটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন।
শোকার্ত: নিহত শিশুর বাবা জন্মেজয় ঘোষ। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
বিকাশ সকালে পড়তে গিয়েছিল। স্থানীয় কে কে হিন্দু অ্যাকাডেমির পড়ুয়া বিল্টুকে নিয়েই ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজে যাচ্ছিলেন সীতাদেবী। প্রতিদিন পরিচিত বলাইচাঁদ পাত্রের বাড়িতেই বিল্টুকে রেখে যান তিনি। ‘‘এ দিনও যদি রেখে যেতেন, ছেলেটার কিছু হত না। সীতাদি আমার শ্বশুরবাড়িতেই ছোট থেকে মানুষ হয়েছেন। আমাদের আত্মীয় হয়ে গিয়েছেন,’’ হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বললেন বলাইবাবুর জামাই দেবাশিস ঘোষ রায়।
সৌভিক ও সঞ্চারী দাস মোদকের ফ্ল্যাটে কাজে এসেছিলেন সীতাদেবী। কিন্তু ওই দম্পতি বাজারে যাওয়ায় ফ্ল্যাট বন্ধ ছিল। তাই ছেলেকে নিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন সীতাদেবী। সৌভিকবাবু বলেন, ‘‘রোজ একাই বাজারে যাই। এ দিন ছুটি বলে দু’জনে গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাট খোলা থাকলে বাচ্চাটা বেঁচে যেত। মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে আসত। খুব শান্ত ছেলে ছিল।’’
জন্মেজয়বাবু জ্ঞান হারাচ্ছেন বারবার। তারই মধ্যে বললেন, ‘‘ছেলেটা অ্যাম্বুল্যান্সেও চেঁচিয়ে বলছিল, ‘বাবা জ্বলে যাচ্ছে। জল দাও।’ পিজি-তে আসার পথেই কেমন ঝিমিয়ে গেল। তার পরে চলে গেল।’’ বিল্টুকে নিয়ে হাসপাতালে আসা পূর্ণিমা রায় জানান, পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থে আইসিইউ বন্ধ। চিকিৎসা হল না। পিজি-তে টিকিট করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার একটু পরেই সব শেষ।
‘‘বিল্টু কেমন আছে,’’ আরজি কর হাসপাতালে হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বারবার জানতে চাইছিলেন সীতাদেবী। বিল্টু আর কোনও দিন খেলনার বায়না করবে না— কথাটা তাঁকে বলতে পারছিল না কেউ।