প্রতীকী ছবি
‘কোন দেশে এক জনও মনোবিদ নেই?’—কিছু দিন আগে পর্যন্ত ছাত্রদের প্রশ্নটা করতেন তাঁদের শিক্ষক। ছাত্রেরা কেউই ঠিক উত্তর দিতে না পারলে শিক্ষকই তার উত্তরটা দিয়ে দিতেন— আফগানিস্তান।
ঘটনাটির উল্লেখ করে কলকাতার মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষ কেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র (আইওপি) অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের সিংহভাগ দেশে মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা এতটাই নগণ্য।’’
কিন্তু এত দিন এ বিষয়ে আলোচনা হলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্মীর অপ্রতুলতার বিষয়টি ভাবাচ্ছে সবাইকেই। কারণ, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি অবসাদ, দুশ্চিন্তা, হতাশাজনিত রোগীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে আত্মহত্যার ঘটনার খবরও আসছে। কিন্তু তা যাতে এ বার ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহে পরিণত না-হয়, সে ব্যাপারে এখন থেকেই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘মেন্টাল হেলথ অ্যাটলাস’-এর ‘মেম্বার স্টেট প্রোফাইল’-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত, সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা হল ২৫ হাজার ৩১২। যেখানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। অর্থাৎ, প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ১.৯৩ বা দু’জন। শুধু তা-ই নয়, দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে যত পরিমাণ খরচ হয়, তার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে খরচের পরিমাণ মাত্র ১.৩ শতাংশ!
সেখানে বিশ্বের প্রথম সারির করোনা-আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার নিরিখে প্রথম স্থানে রয়েছে ব্রাজ়িল (৩১৭.৪৫)। তার পরের দেশগুলি হল যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (২৭১.২৮), ফ্রান্স (১৭৩.৬৩), জার্মানি (১৪৪.৮৭), ইটালি (৫৫.৭২), পেরু (৩২.০৩)। যেখানে মোট সংক্রমিত রোগীর নিরিখে ভারত বর্তমানে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের মধ্যে চলে এসেছে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে এ দেশের অবস্থা কতটা শোচনীয়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, সাধারণ সময়ে অবসাদ, মানসিক হতাশা কাটানোর জন্য একটা হেল্পলাইন সব সময়েই চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে সব দেশই আত্মহত্যা ঠেকাতে একটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’-এর ফেলো অধ্যাপক তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে বলছেন, ‘‘সবাই আত্মহত্যা করবেন এতটা নেতিবাচক ভাবা উচিত নয়। কিন্তু মানসিক অবসাদের মাত্রা ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। রোজগারের অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে একটা সার্বিক অনিশ্চয়তা কাজ করছে, যা সমাজের সব স্তরকে স্পর্শ করেছে।’’
সংক্রমণ কবে থামবে, তার পরে পরিস্থিতি কী হবে— এই চিন্তাই সেই অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞেরা। যেমন এপিডিমিয়োলজিস্ট তথা জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ কুণাল মজুমদার বলছেন, ‘‘এখনও এপিডেমিক-কার্ভ ঊর্ধ্বমুখী। সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছনোর পরে তা নিম্নমুখী হবে। তার পরে শুরু হবে পোস্ট-কোভিড পর্ব। কিন্তু সেটা কবে হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।’’
যেমন পরিষ্কার নয়, আগামী দিনে মানসিক অবসাদের মাত্রা ও সে সংক্রান্ত কী ধরনের বিপর্যয় আসতে চলেছে। আইওপি-র অধিকর্তার কথায়, ‘‘আটটি দল গঠন করে আমরা সমস্ত কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্রে কাউন্সেলিং করছি। স্বাস্থ্য ভবনে ফোনের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করছি। কিন্তু দেশে মনোরোগ চিকিৎসকের সংখ্যা যে কতটা কম এবং বিপর্যয়ের সময়ে তার ফল কী হতে পারে, সেটা কোভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।’’
কিন্তু তার ফলে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না, তা অবশ্য সংক্রমণ থামার মতোই অনিশ্চয়তায় ভরা!
আরও পড়ুন: ট্র্যাফিক গার্ড ও ব্যারাক পরিদর্শন ডিসির