সহাবস্থান: রমজান মাসের জ়াকারিয়া স্ট্রিটে অনেকের সঙ্গেই ইফতারে বসেছেন সেখানে ঘুরতে আসা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। বৃহস্পতিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
জড়ো হওয়া ভিড়টায় অনেকেরই জীবনে প্রথম ইফতারের অভিজ্ঞতা। কেউ কেউ জ়াকারিয়া স্ট্রিট তল্লাটও প্রায় চেনেন না। বৃহস্পতিবার বিকেলে শহরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া-শিক্ষিকাদের দলটিকে নাখোদা মসজিদের গল্প শোনাচ্ছিলেন গোলাম সৈফুদ্দিন উসমান। কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্যের দোতলায় পাশের ‘খলিল মঞ্জিল’টি দেখিয়ে গওহরজান ও মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদের গল্প বললেন তিনি।
ওই চত্বরের আদি মসজিদটির সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন প্রধানত সিন্ধুদেশ থেকে কলকাতায় আগত কচ্ছ মেমন গোষ্ঠীর মুসলিমরা। তাঁদের পুরোধা শেখ আব্দুল রহমান উসমান হলেন সৈফুদ্দিনের ঠাকুরদা। মসজিদের সংস্কারের জন্য তৎকালীন চিৎপুর রোডের বেশ কয়েকটি বাড়িই অধিগ্রহণ করতে চাইছিলেন তিনি। ‘খলিল মঞ্জিল’-এর অধীশ্বরী তখন কলকাতার কোকিল গওহরজান। মসজিদের পুণ্যকাজে এক কথায় নিজের বাড়ি দিতে রাজি হয়ে গেলেন সঙ্গীত-সম্রাজ্ঞী। বিনিময়ে একটি পয়সাও তাঁর চাই না! উসমান সাহেব কিন্তু দান নিতে রাজি হননি। শেষমেশ গওহরজানের বাড়ি বাদ রেখেই বাকি অংশে মসজিদ গড়ে উঠল। পাথর এসেছিল রাজস্থানের মাকরানা, উত্তরপ্রদেশের ঢোলপুর থেকে। হাঁ করে সেই গল্প শুনছিলেন দুর্গাপুরের সৃজা সাধু, টালিগঞ্জের প্রিয়ম চট্টোপাধ্যায় বা সল্টলেকের তরী দত্ত মজুমদার। সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা আইনের পড়ুয়াদের দলটির সামনে এই প্রথম জ়াকারিয়া স্ট্রিট, কলুটোলার প্রাচীন ইতিহাস মেলে ধরা হল।
আজকের কলকাতায় রমজ়ানি জ়াকারিয়ার চেহারাটা প্রায় বড়দিনের পার্ক স্ট্রিটের মতোই ঝলমলে। কাবাব, হালিম, ফালুদা, শিরমল, বাখরখানির টানে অনেকেই এ গলিগুলি দিব্যি চিনে ফেলেছেন। জ়াকারিয়াকে ঘিরে এ বার ছক-ভাঙা ভাবনার ছোঁয়াচ দেখল কলকাতা। শহরের নানা রঙা জাতধর্মের পড়শিদের কাছে টানার মঞ্চ ‘নো ইয়োর নেবার’-এর সৌজন্যে স্রেফ সুখাদ্য নয়, জ়াকারিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্যের কথাও এ দিন তুলে ধরা হল। ফিয়ার্স লেনে শহর কাঁপানো সুতলি কাবাবের ঠেকের উল্টো দিকেই ভক্ত পূর্ণচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি পড়েছিল।
মহম্মদ আলি লাইব্রেরির উর্দু রামায়ণের কথা শুনতে শুনতেই কলেজপড়ুয়ারা এ দিন মতি শীল বা বদনচাঁদ রায়ের বাড়ি ঘুরে এলেন। রায়বাড়ির পশুপতি রায়, দিলীপ রায়েরা শোনাচ্ছিলেন, ’৪৬-’৪৭-এর অশান্ত দিনে কী ভাবে মুসলিম পড়শিরাই তাঁদের পাশে দাঁড়ান। আবার নাখোদা মসজিদের সেবক পরিবারভুক্ত গোলাম সৈফুদ্দিন উসমান দেখালেন, ইফতারের সময়ে কী ভাবে জাতধর্ম, পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে সবার জন্য নাখোদায় অবারিত দ্বার। রাজনীতির বিভাজনের দিনকালে সহাবস্থানের জোরটাই চিরন্তন কলকাতার কথা বলে গেল।