মেয়ো রোড
তার গতি ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। স্থায়িত্ব মিনিট সাতেক। পরিণাম— তিনটি মৃত্যু, অন্তত ৬২টি গাছ পড়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ, বিঘ্নিত ট্রেন চলাচল, লন্ডভন্ড গোটা শহর। বুধবার সন্ধ্যার পরে এক নজরে এটাই ছিল কলকাতা।
এ দিন সন্ধ্যায় ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে নামা প্রবল বৃষ্টিতে বিভিন্ন জায়গায় আহত হন মোট পনেরো জন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জনের অবস্থা গুরুতর। থইথই জলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে শহরের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম। অফিসফেরতা মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয় ওভারহেড তার ছিঁড়ে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়া। মেন লাইনেও ট্রেন চলেছে ধীরে। স্টেশনে থিক থিক করেছে কালো মাথা। গভীর রাতেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে অপেক্ষমাণ মানুষ। বাস নেই, ট্যাক্সি নেই। ওলা-উবের, অটো বিশাল টাকা হেঁকেছে।
ঝড়-বৃষ্টিতে সব চেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে যাদবপুরে। পুলিশ সূত্রের খবর, একটি গাছ ভেঙে পড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালের উপরে। গাছের চাপে দেওয়াল ভেঙে পড়ে ফুটপাথে বসে থাকা জনা সাতেকের উপরে। যার জেরে মৃত্যু হয়েছে এক তরুণী-সহ দুই পথচারীর। বছর পঁয়ত্রিশের মৃত যুবককে রাত পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। মৃত তরুণীর নাম মধুমিতা হেমব্রম (১৮)। বাড়ি মেটিয়াবুরুজে। গুরুতর আহত অবস্থায় বাকিদের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাদবপুর এলাকার এক বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁদের এক জন ভেন্টিলেশনে রয়েছেন। পুলিশ জানায়, ওই যুবকেরা ফুটপাথে বসে ফ্রি ওয়াই-ফাই পরিষেবা ব্যবহার করছিলেন। তাঁদের কেউই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া নন বলে পুলিশ জানিয়েছে। রাতে ওই হাসপাতালে যান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, মেয়র পারিষদ রতন দে, দেবাশিস কুমার প্রমুখ। হাসপাতালে শুয়ে আহতদের এক জন (বাড়ি আলিপুরদুয়ার) ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা কয়েক জন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওয়াইফাই ব্যবহার করছিলাম। হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে দেওয়াল। আমরা কয়েক জন তার নীচে চাপা পড়লাম। আমাদের উপরে ইট, তার উপরে গাছ। কী ভাবে যে বেঁচে গেলাম, জানি না।’’
বেলেঘাটায় প্রাণ হারান ৬৫ বছরের অমর মুখোপাধ্যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, এ দিন ঝড় ওঠার সময়ে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন অমরবাবু। সেই সময়ে একটি গাছ তাঁর উপরে ভেঙে পড়ে। হাসপাতালে ওই প্রৌঢ়কে মৃত ঘোষণা করা হয় অমরবাবুকে।
এ দিন সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে ওঠা এই ঝড়ে শহরের বহু জায়গায় গাছ ভেঙে পড়ে। তাতে যেমন রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তেমনই বেশ কিছু অঞ্চলে তার ছিঁড়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ পরিষেবাও। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ঝড়বৃষ্টির দাপটে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত কলকাতা বিমানবন্দরে কোনও বিমান নামতে পারেনি। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, এর মাঝে পটনা থেকে আসা ইন্ডিগোর উড়ান-সহ মোট তিনটি বিমান কলকাতায় নামতে না পেরে ভুবনেশ্বর চলে যায়। তার পরে আরও দু’টি বিমান ফিরে যায় ঢাকা এবং গুয়াহাটিতে। এ ছাড়া, প্রায় ৮-১০টি বিমান ৪০ মিনিটের বেশি সময় ধরে কলকাতার আকাশে চক্কর কাটে। অনেক বিমানই ৪৫ মিনিটের বেশি দেরিতে ছাড়ে।
ঝড়বৃষ্টি চলাকালীন নবান্ন থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চারপাশের পরিস্থিতি দেখেই তিনি মেয়রের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। রাত পর্যন্ত পরিস্থিতির উপরে নজরদারিও চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন মেয়রও। ময়দান এলাকা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে একটি গাছ আলোকস্তম্ভ নিয়ে তাঁর গাড়ির ঠিক সামনেই ভেঙে পড়ে। অল্পের জন্য রক্ষা পান মেয়র। পরে তিনি বলেন, ‘‘ঝড় থামার সঙ্গে সঙ্গে পুরসভার কর্মীরা গাছ কাটার বৈদ্যুতিন করাত নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। ৩০-৩২টি দলকে রাস্তা মুক্ত করতে নামানো হয়েছে।’’ পুরসভার কর্মীদের পাশাপাশি বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীদেরও গাছ কাটার জন্য নামানো হয় বলে মেয়রের দাবি। শোভনবাবু নিজেও রাস্তায় ছিলেন। তবে রাত ১০টা পর্যন্ত কলকাতার বহু রাস্তাই বন্ধ ছিল। রাত পর্যন্ত গুরুসদয় রোড, টালিগঞ্জে এন এস সি বসু রোড, হসপিটাল রোড, মল্লিকবাজারে গাছ সরানো যায়নি।
ঝড়ের দাপটে গাছের ডাল ভাঙে বিধাননগর পুর নিগম এলাকার বিভিন্ন জায়গায়। নিগমের মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল) দেবাশিস জানা জানিয়েছেন, সল্টলেকের নেতাজি পার্কের সামনে দাঁড়ানো একটি গাড়ির উপরে একটি গাছ ভেঙে পড়ে। আটকে পড়েন গাড়ির ভিতরে থাকা এক ব্যক্তি। অবশ্য তাঁকে সুস্থ অবস্থাতেই উদ্ধার করা গিয়েছে বলে জানান দেবাশিসবাবু। মেয়র পারিষদ জানান, বড় গাছ তেমন না ভাঙলেও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে সল্টলেকের বিভিন্ন জায়গায়। একই অবস্থা হয় বাগুইআটি, কেষ্টপুর-সহ বিভিন্ন এলাকায়। রাতেই পুর নিগমের তরফ থেকে শ্রমিকদের দ্রুত রাস্তা পরিষ্কারের কাজে নামানো হয়েছে। লেকটাউনে গাছের ডাল ভেঙে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে। তার জেরে রাত পর্যন্ত অন্ধকারে ডুবে ছিল ভিআইপি রোড।
রেল সূত্রের খবর, সোনারপুরে রেলের ওভারহেড তারের উপর গাছ ভেঙে পড়ে সোনারপুর, বারুইপুর শাখায় ট্রেন চলাচল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে বন্ধ। ছিল। রেল সূত্রে খবর, বেলঘরিয়ায় ওভারহেড তারের উপরে তিনটি গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। হাওড়ায় ট্রেন চলেছে অতি ধীরে। মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানান, বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয় তাঁদের পরিষেবাও। নোয়াপাড়ায় গাছ পড়ে মেট্রো চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে দমদম পর্যন্ত চলে মেট্রো। তাতেও চাঁদনি থেকে দমদম যেতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা।
যে সমস্ত রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে, সেগুলি হল— হরিশ মুখার্জি রোড, জাজেস কোর্ট রোড, আহিরীপুকুর ফার্স্ট লেন, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ, আমহার্স্ট স্ট্রিট, বেলেঘাটা মেন রোড, বিপিন পাল রোড ও ল্যান্সডাউন রোড ক্রসিং, হরিশ মুখার্জি রোড, রবীন্দ্র সরণি, শরৎ বসু রোড, এ জে সি বসু রোড, সাদার্ন অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, হাজরা রোড (ল’ কলেজের সামনে)। রানিকুঠি এবং ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর সামনেও গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এ ছাড়া হাওড়া, সল্টলেক, গোলপার্ক, লেক টাউনের বিভিন্ন রাস্তাতেও গাছ ভেঙে পড়ে যানবাহন আটকে পড়ে। নবান্নেও ঝড়ের দাপটে ভিআইপি গেটের সামনে মেটাল ডিটেক্টর ডোরফ্রেম উল্টে যায়।
রাতে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ জানায়, ঝড়ের পরে বেলেঘাটা মেন রোড, রাজা সুবোধ মল্লিক রোড, সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ, মেয়ো রোড, ডাফরিন রোড, ভিআইপি রোডের একাংশ গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। রেড রোডে ১৫ অগস্টের মণ্ডপ ভেঙে পড়ে বন্ধ হয়ে যান চলাচল। বিভিন্ন বড় রাস্তা বন্ধ থাকার পুরো সুযোগ নেয় ওলা-উবের-ট্যাক্সি-অটো। ধর্মতলা থেকে বাগুইআটি যেতে ওলা-উবের রাত নটা নাগাদ ৬০০ টাকা ভাড়া দাবি করে। শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙা অটো নিয়েছে ১০০ টাকা। তবে কালীঘাট, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বেহালার মতো অনেক রুটেই বৃষ্টির পরে অটো চলাচল ঘণ্টা দুই বন্ধ ছিল।
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক