ভরসার হাত। চিৎপুরে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচারে রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ, সঙ্গে প্রার্থী প্রমীলা সিংহ।
শ্রীখণ্ড-খাণ্ডবীর কাছে পিছু হটল রবিবাসরীয় মাংস-ভাত।
ব্যস্ত দুপুরে পদ্মপুকুরের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে গুজরাতি মেনুতেই পিত্তরক্ষা হল শাসক দলের মেয়র পদপ্রার্থীর। শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য একা নন। স্থানীয় সাংসদ সুব্রত বক্সী, ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম, পুর-নেতা সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ভবানীপুরের গুজরাতি ভূমিপুত্র, সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী— হাজির সক্কলে। পুরভোটের আগে শেষ রবিবার, গোটা দক্ষিণ কলকাতার ‘টিম তৃণমূল’ দুপুরটা কার্যত এ শহরের গুজরাতি-সমাজের জন্যই উৎসর্গ করলেন।
লোকসভা ভোটের মোদী-হাওয়ায় এ শহরের পাঁচমিশেলি মহল্লা তথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা এলাকাতেই বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে পড়েছিল তৃণমূল। এ যাত্রা, পুরভোটে প্রচারের স্লগ ওভারে কিন্তু একেবারে অন্য মেজাজ। লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের আসরে মমতার প্রার্থীদের চিনিয়ে দেওয়া চলছিল। গুজরাতি সমাজের সভাপতি রবীন্দ্র ভাগানি ওরফে বালাভাই হট ফেভারিট তৃণমূলকে চ্যাম্পিয়নের তকমাই দিয়ে ফেললেন। মন্দির-চত্বরে পায়রাদের দেদার দানা খাওয়ালেন শোভন। গুজরাতি ভাষায় দীনেশ ত্রিবেদীর সরস বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে কুটিপাটি। জাতীয় রাজনীতির কচকচির সঙ্গে সম্পর্কহীন এই ভোটটা যে নাগরিক-জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, দীনেশ তা খানিক রসিকতার ছলেই মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন।
শাসক দলের প্রতিপক্ষ বিজেপি অবশ্য ভোটটা অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছে। বিভিন্ন প্রাক্-ভোট সমীক্ষায় যা-ই বলা হোক না কেন, বিধানসভা ভোটের আগে এটা সেমিফাইনাল বলে জাহির করেই মাঠে নেমেছে পদ্মফুল-বাহিনী। সকালে কাশীপুরের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সামনে ‘দ্রৌপদী’ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা-পর্বে এ সবই বলা হচ্ছিল।
রূপা কখন আসেন, তার প্রতীক্ষায় ময়দা মাখার ফাঁকে বার-বারই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলেন স্থানীয় শাকাহারী হোটেলের কর্মচারী মুকেশ কুমার। বিজেপি-র জনৈক সুবেশ নেত্রীকে হুডখোলা জিপে উঠতে দেখে অত্যুৎসাহী হয়ে এক বার তাঁকেই ‘দ্রৌপদী’ ভেবে বসলেন। দক্ষিণে লেকের কাছে কর্মীদের সঙ্গে মিটিং সেরে রূপা প্রত্যন্ত উত্তরে পৌঁছলেন এর খানিকক্ষণ বাদেই। চূড়িপাড়া, ঘোষবাগানের বস্তিবাসীরা তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে খিলখিলিয়ে হেসে জিপের দিকে ছুটলেন। রোড শো, সভা, পদযাত্রা, যাদবপুর থানায় দলের ছেলেদের অপদস্থ করার অভিযোগে একপ্রস্ত দরবার করার ফাঁকে বিডন স্ট্রিটের এক বন্ধুর বাড়িতে একটু দইভাত খাওয়ার সময়টুকু বার করলেন রূপা।
সিপিএমের রূপা বাগচীর কাছে এ সব ঝক্কি এখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। লোকসভার ম্যারাথন ভোট-প্রচারের পরে বছরখানেকের মধ্যে স্রেফ একটা ওয়ার্ড কভার করা তো কার্যত ১০০ মিটার দৌড়ও নয়। উল্টোডাঙায় বিআরএস-৩ সংগ্রামীর পুজোর মাঠে তবু অটোয় চেপে সকাল-সকাল হাজির হলেন তিনি। এসেই ব্যস্ততা। ‘‘শ্রীকৃষ্ণ কলোনিতে ওরা আমাদের একটা পতাকাও লাগাতে দিচ্ছে না। যাই ছেলেদের একটু চাঙ্গা করে আসি।’’— বলেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হেঁটে-হেঁটে চক্কর শুরু করে দিলেন তিনি।
শেষ রবিবারের তরজার ঝাঁঝটা অবশ্য মালুম হল বিকেলে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেলেঘাটায় প্রচারে নামার পরে। বিরোধীদের বিঁধে নেত্রীর স্বভাবসিদ্ধ ডাকাবুকো ভঙ্গিতেই ছুটির দিনের চায়ের মৌতাত জমজমাট। বিজেপি-র রাহুল সিংহ, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থেকে শুরু করে সিপিএমের বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য সকলেই এক-একটি চরিত্র দিনের প্রচার-পর্বে। দু’দিন বাদেই সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস বিশাখাপত্তনমে। বিমান-সূর্যদের জন্য এই রবিবারই কার্যত প্রচারের শেষ দিন। ধাপা, কসবা, রাজাবাজার—সকাল থেকে বিকেল পদযাত্রা-সভায় শহরে নিজেদের উপস্থিতি বোঝাতে লড়লেন সিপিএমের প্রবীণ নেতারা।
খেলার মাঠের নায়করাও এখন ভোট-ময়দানের খেলাটা দিব্যি ধরে ফেলেছেন। সাতসকালে পাইকপাড়ার বীরপাড়ায় ব্যারেটোকে কিছু বলতেও হল না। তৃণমূলের শান্তনু সেনের জন্য রোড-শোয়ে এসে ডগলাসের সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় আড্ডা দিতে দিতেই জিপে ঠিক জায়গায় পোজিশন নিলেন। গলির বাজারে মাছ কোটা বা জিলিপি ভাজা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল তারকাদের দেখে। তবে রোড শো-র রঙে চোখ ধাঁধালেন কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠক। মিলেনিয়াম পার্ক থেকে কলাকার স্ট্রিট হয়ে উত্তরমুখী সফর ধারে-ভারে জাত চিনিয়ে গেল। শাসক দলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীরা পথে নেমেছিলেন। প্রচারের পরিশ্রমে নজর কেড়েছেন সিপিএমের অভিজ্ঞ পুরযোদ্ধা সুধাংশু শীল বা বিজেপি-র মীনাদেবী পুরোহিতও।
আইপিএল-এর জৌলুসের সঙ্গে তুলনায় এই পুরভোট ঠিক মাপে আসবে না। তবে বড় ম্যাচে জমি না-ছাড়ার জেদেই দিনটা রঙিন হয়ে থাকল।
ছবি: সুমন বল্লভ, সুদীপ্ত ভৌমিক, শশাঙ্ক মণ্ডল এবং নিজস্ব চিত্র।