শান্তিবালা মজুমদার
লকডাউনের মধ্যে কোভিড-আতঙ্ক সত্ত্বেও ক্যানসারের চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার কতটা জরুরি, বার বার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কারণ, এই রোগ নির্ণয়ে দেরি হলে বা চিকিৎসা বন্ধ থাকলে জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবুও পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার ছবি দেখা গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। উল্টো দিকে আবার সংক্রমণের ভয়কে জয় করে বছর পঁচাশির এক রোগিণীর ক্যানসার নির্ণয় এবং অস্ত্রোপচারে সুস্থ হয়ে ওঠার কাহিনি দৃষ্টান্ত তৈরি করল। এ কথা বলছেন চিকিৎসকেরাই।
লকডাউন ঘোষণার সময়ে কৃষ্ণনগরের শিমুলতলার মজুমদার পরিবার ভাবতে পারেনি, কতটা কঠিন সময় আসতে চলেছে তাদের। বড় ছেলে ও বৌমার সঙ্গে সেখানেই থাকেন শান্তিবালা মজুমদার। এপ্রিলের মাঝামাঝি বৌমা দেখেন, শাশুড়ির মুখের ভিতরে, ডান টাকরার কিছুটা অংশ কালো হয়ে আছে এবং রক্ত পড়ছে।
কৃষ্ণনগরেই চিকিৎসা শুরু হয়। দুই দফায় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও লাভ হয়নি। পরিবার সূত্রের খবর, কোভিড-আতঙ্কে চিকিৎসকেরা কেউ বৃদ্ধার মুখে হাত দিচ্ছিলেন না। দূর থেকে দেখেই পরীক্ষা করাতে বলা হয়। যানবাহন বন্ধ থাকায় রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছিল। তাই চিকিৎসককে দিয়ে ‘ইমার্জেন্সি’ লিখিয়ে নিয়ে ১৩ মে গাড়িতে কলকাতায় চলে আসেন তাঁরা। ক্যানসার চিকিৎসক সোমনাথ সরকারের কাছে শুরু হয় চিকিৎসা। বায়োপসি করিয়ে জানা যায়, ডান টাকরায় (হার্ড প্যালেট) ‘অ্যাডেনয়েড সিস্টিক কার্সিনোমা’ হয়েছে বৃদ্ধার। পাঁচ সেন্টিমিটারের থেকেও বড় টিউমারটি দ্রুত অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া জরুরি।
চিকিৎসকেরা জানান, অপেক্ষা করলে ক্যানসার আশপাশের গ্ল্যান্ড এবং অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারত। তাই রোগিণীকে ভর্তি করানোর পরে কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ মাসেই ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চিকিৎসক অভিষেক গুহঠাকুরতা ও সৌমিত দে অস্ত্রোপচার করেন। অ্যানাস্থেটিস্ট ছিলেন তুষারকান্তি ঘোষ।
গৌতমবাবু বলেন, “টোটাল ম্যাক্সিলেক্টমি অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয় ডান টাকরা। রোগিণী মানসিক ভাবে দৃঢ় হওয়ায় চিকিৎসায় ইতিবাচক ফল মিলছে। আর সপ্তাহ কয়েক পরে তাঁকে দেখে নিয়ে ওই গর্তটি ঢাকতে প্রস্থেসিস করা হবে। তাতে ওঁর খাওয়া ও কথা বলায় সমস্যা মিটবে।”
সোমনাথবাবুর কথায়, “ওঁর টিউমারটি চিকিৎসার পরিভাষায় টি-ফোর (যথেষ্ট বড়) হয়ে গিয়েছিল। সংক্রমণের আতঙ্ক আর রোগিণীর বয়স, এই দুই কারণে সতর্কতা নিয়ে চিকিৎসা চলেছে। তবে পরিবারের ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।”
যদিও শাশুড়ির চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন বলে মনে করেন না বৌমা শুভ্রা বিশ্বাস মজুমদার। কলকাতায় বাবার বাড়িতে শাশুড়ি মাকে নিয়ে থাকছেন তিনি। কৃষ্ণনগরে পরিবারের বাকিরা থাকলেও চিকিৎসা-পর্ব শেষ করেই ফিরবেন সেখানে। শুভ্রা বলছেন, “এখন রাইলস টিউবে খাচ্ছেন। কথা বলতে গেলে যে সমস্যা হচ্ছে, পরবর্তী চিকিৎসায় সে সব ঠিক করা হবে। শাশুড়ি মা মানসিক ভাবে খুব শক্ত। ওই মনোভাবই দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করছে ওঁকে।”
এ ক্ষেত্রে রোগিণীর পরিবার এবং চিকিৎসকদের ভূমিকা প্রশংসনীয় বলে জানাচ্ছেন ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ঝুঁকি থাকায় এই বয়সে ডাক্তারেরা অস্ত্রোপচার করতে চান না। তার সঙ্গে বর্তমান সমস্যা জুড়ে পরিস্থিতি এখন জটিল। কিন্তু জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলা করা মস্ত ভুল হবে। পরিবারেরও এতে ভূমিকা থাকে। শান্তিবালাদেবীর পরিবার সেটাই দেখিয়েছে।”
আরও পড়ুন: পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁতে খাবার অর্ডার দিয়ে প্রতারিত, পিছনে জামতাড়া গ্যাং