এমনই হাল কালীবাড়ি রোেডর পাশে একটি খালের। রবিবার ছবিটি তুলেছেন শৌভিক দে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এর পরেও অবশ্য রবিবার প্রয়োজনীয় তৎপরতা দেখা গেল না বিধাননগর বা দমদম কোনও পুরসভাতেই। বি সি রায় শিশু হাসপাতালে এ দিনও ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছে সল্টলেকের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক শিশুর। ডেঙ্গি-যুদ্ধে বিধাননগরে কিছুটা উদ্যোগ চোখে পড়েছে বটে, তবে পরিস্থিতির নিরিখে তা যথেষ্টই কম। আর দমদমের পরিস্থিতি এখনও বেহাল। রবিবার দিনভর দুই পুর-এলাকায় ঘুরে বেড়িয়ে এ ছবিটাই চোখে পড়ল।
চিত্র ১। ইটালগাছা রোডের উপরেই ফাঁকা প্লট। সেখানে বহুতল তৈরি হবে। প্লটের অধিকাংশটাই ভরে রয়েছে বৃষ্টির জলে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সকলেই সব দেখতে পাচ্ছে। পাচ্ছে না শুধু দমদম পুরসভা।
চিত্র-২। দমদমের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কালীবাড়ি রোডের এক প্রান্তে রেললাইনের গা বরাবর খাল। আবর্জনা জমে থমকে গিয়েছে জলপ্রবাহ। আবর্জনার মধ্যে পড়ে রয়েছে কাগজের কাপ, থার্মোকলের বাটি, থালা-সহ নানা বস্তু।
চিত্র-৩। আড়াই নম্বর গেটের কাছে মতিলাল কলোনিতে চলছে বহুতল নির্মাণ। ভিতরে ছোট ডোবা জলে ভরা। পাশেই ফাঁকা জমিতে রাখা মেঝে তৈরির মার্বেলের স্ল্যাব। শ্যাওলা-ধরা স্যাঁতস্যাঁতে জমির সবটা জুড়েই জল। নির্মাণকর্মীরা জানান, তাঁরা দিনের বেলাতেও মশারি টাঙাতে বাধ্য হন।
অভিযোগ, ডেঙ্গির থাবা যখন শহরের বুকে ক্রমেই শক্ত হয়ে বসছে, তখনও ঘুম ভাঙছে না দমদম পুরসভার। এ দিনের খণ্ডচিত্রগুলিও অবশ্য তারই স্বাক্ষ্য বহন করছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, মশার মারার তেল বা ধোঁয়া দূরে থাক, পুরসভাকে ন্যূনতম ব্লিচিং পাউডার ছড়াতেও দেখা যাচ্ছে না। যদিও ইতিমধ্যেই ১০ জনের ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার খবরও পুরসভার হাতে এসেছে। ১ নম্বর গেটের কাছে ইটালগাছা রোডের বাসিন্দা সন্দীপন বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘গত দশ-বারো বছরে এই চত্বরে কোনও দিন মশার তেল বা ধোঁয়া দিতে দেখিনি।’’ অথচ রাতে তো বটেই দিনের বেলাও ওই সব জায়গায় মশার উপদ্রব বলেই অভিযোগ নাগরিকদের। এলাকায় জল জমে রয়েছে। তা সরানোর বিষয়ে কোনও তৎপরতা নেই বলেও অভিযোগ করছেন তাঁরা। নলতা পঞ্চায়েত পার্ক এলাকার বাসিন্দা অনিন্দিতা হালদারের কথায়,‘‘আমাদের বাড়ি খালের ধারে। মশার তেল আর ধোঁয়া দেওয়ার জন্য দমদম পুরসভায় আবেদন করেছি। কাজ হয়নি তাতে।’’
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে দমদম পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) রিঙ্কু দত্ত দে-র দাবি, নিয়মিত মশা মারার তেল, ধোঁয়া দুই-ই দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, জমা জল সরিয়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই জলে পোড়া মোবিল দিতে হবে।
বিধাননগরের মতো দমদম পুরসভাও অবশ্য দায় চাপিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার উপরে। অভিযোগ, দমদম পুর-এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধার দিয়ে রেল লাইন বরাবর যে খাল গিয়েছে, রেল তার সংস্কার করছে না। মেয়র পারিষদের কথায়, ‘‘বারবার রেল দফতরকে চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও নয়ানজুলি পরিষ্কার হয়নি। দমদম পুরসভাই এখন উদ্যোগী হয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধারের খালটি পরিষ্কার করছে। ওই সব কাজই রেলের করার কথা।’’
দমদমে যখন এই অবস্থা, তখন বিধাননগরে কিছুটা হলেও পুর-প্রশাসনের তৎপরতার ছবি। তবে সেই ব্যবস্থা এখনও প্রয়োজন মেটাতে সফল হয়নি। বিধাননগরে একটি স্কুলের দুই পড়ুয়ার মৃত্যুর পরে রবিবার ফের মৃত্যু হয় দিশা দাস (১১) নামে এক শিশুর। তার বাড়ি ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসন্তীদেবী কলোনিতে। এ নিয়ে বিধাননগর পুর-এলাকায় ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিনে।
শনিবার থেকে শুরু করা বিশেষ অভিযানে ওয়ার্ড-পিছু ১৩ থেকে ২৫ জনের একটি দল বাড়ি বাড়ি নজরদারি, তথ্যসংগ্রহ ও সচেতনতার কাজ করছে বিধাননগর পুরনিগম। তেমনই প্রতিটি বরো-পিছু একটি বিশেষ দলও বরো এলাকায় মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে পথে নেমেছে। সার্বিক ভাবে নজরদারিতে রয়েছেন কাউন্সিলরেরা। যে সমস্ত বাড়িতে জমা জল, মশাবাহিত রোগের জীবাণুর সন্ধান মিলছে, সেগুলিতে পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। যদিও কর্মী এবং পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়ে গিয়েছে এখনও। এক কাউন্সিলর জানান, কখনও কর্মী মিলছে না, কখনও কর্মী এলেও তাঁদের কাজের মান সন্তোষজনক নয়। বিধাননগরের মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায় বলেন, ‘‘অস্থায়ী ভাবে নিযুক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আরও কর্মীও নিয়োগ করা হচ্ছে। কাউন্সিলরের নেতৃত্বে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে নজরদারি রাখা হচ্ছে।’’
২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা বরো-চেয়ারম্যান বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জমা জল সরাতে অবিলম্বে ঠিকাদারদের কাছে নোটিস পাঠানো হচ্ছে। তাঁর দাবি, ‘‘কাজের গতি বজায় রাখলে দিন পনেরোর মধ্যেই পরিস্থিতি বদলাবে।’’ অন্য দিকে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান অনিতা মণ্ডল বলেন, ‘‘বাড়ি বাড়ি ঘুরছি। তবে বাসিন্দাদের একাংশ সচেতন নন। শুধু পুরসভার ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে একযোগে কাজ করলে দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টাবে।’’
পুরকর্মীদের পাল্টা ক্ষোভ অবশ্য বাসিন্দাদের ভূমিকা নিয়ে। তাঁদের একাংশের কথায়, অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা জোর করেই বাড়িতে ঢুকতে হচ্ছে। এক পুরকর্মী বলেন, ‘‘একটি বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখি ড্রামে জমা জল। সেই জল বদলানোও হয়নি। বাড়ির গৃহকর্ত্রী দায় চাপিয়েছেন পরিচারিকার উপরে।’’
এমন অভিযোগ শুধু একটি ব্লকেই নয়, বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে বাসিন্দাদের একাংশের এমন অসহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন কাউন্সিলরেরাও। তবে বাসিন্দাদের একটি সংগঠনের কর্মকর্তা কুমারশঙ্কর সাধুর দাবি, ‘‘দোষ চাপানোর সময় নেই। পুর-কর্তৃপক্ষ যদি ব্লক কমিটিগুলিকে এই কাজে যুক্ত করেন, তবে দ্রুত কাজ হবে। একযোগেই সমস্যা সমাধান করতে হবে।’’