প্রতীকী ছবি।
খবর ছিল, ‘কুরিয়রের’ মাধ্যমে মাদক পৌঁছচ্ছে লেক টেম্পল রোডের একটি বাড়িতে। চার বন্ধু সেখানে দু’টি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। বড় দিনের আগের দু’সপ্তাহে ওই দুই ফ্ল্যাটেই এমন বিদেশি কুরিয়র এসেছে অন্তত চার বার! কিন্তু অকুস্থলে হানা দিয়ে মাদক উদ্ধার হয়নি, কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি পুলিশ। তবে মিলেছে কয়েকটি কুরিয়রের খাম। কুরিয়র সংস্থা বলেই দিয়েছে, “খামে কী থাকে জানি না। সেটা দেখার কথাও নয়!”
কিন্তু সন্দেহ ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না তদন্তকারীরা। কারণ, ওই ফ্ল্যাট থেকেই পুলিশ ডেস্কটপ কম্পিউটারের সঙ্গে রাখা দু’টি ল্যাপটপ পেয়েছে। সেগুলি স্বাভাবিক নিয়মে চলে না। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিন বা অ্যাপ্লিকেশনের কাজ নেই তাতে। পাসওয়ার্ড দিয়ে কম্পিউটার খুললেই দেখা যায় কালো ‘উইন্ডো’! এক তদন্তকারীর কথায়, “সাধারণ কম্পিউটারের আড়ালে গোপন জগৎ। নাম, টর ব্রাউজ়ার। যার মাধ্যমে পৌঁছনো যায় মাদকের বাজারে। অর্ডার দিলেই কুরিয়রে এসে যায় মাদক।”
বছর দুয়েক ধরেই তদন্তকারীদের গলার কাঁটা মাদক কারবারে কুরিয়রের ব্যবহার। পুলিশ সূত্রের খবর, করোনা পরিস্থিতিতে যা বেড়েছে। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়ি বসে বিভিন্ন জিনিস আনাতে চাহিদা বাড়ছে কুরিয়রের। সেই পথেই বাড়ছে মাদকের কুরিয়রও। ফলে নানা হাত ঘুরে আসা মাদক কুরিয়রের মাধ্যমে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে শীতের রাত-পার্টিতে। পার্সেলের ওজন এবং কতটা দূরত্বে তা পাঠাতে চাইছেন, কুরিয়র সংস্থাকে তা জানালেই হল। যদিও হাতে-নাতে না ধরলে কিছুই করা যাচ্ছে না, জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের মাদক সংক্রান্ত বিষয়ের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘একটা হয়, অপরাধের পরে গ্রেফতার। আর একটা হয়, অপরাধ করার আগেই আটকানো। মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করাটা দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়ে। মাদক-সহ আটক করতে না পারলে গ্রেফতার করা যায় না। এতেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে টর ব্রাউজ়ার আর কুরিয়র।’’ তাঁর দাবি, বহু কুরিয়র সংস্থার বক্তব্য, পার্সেলে কী রয়েছে তা জানতে চাওয়া ‘রুল বুক’ বিরোধী।
আরও পড়ুন: ‘বাধ্য’ হয়েই কি স্বাস্থ্যসাথীতে নাম নতুন ২০ হাসপাতালের
আরও পড়ুন: বাড়ি ফিরলেন আইনি জটে ‘পাগল’ তকমায় বন্দি যুবক
দীর্ঘদিন কলকাতায় কাজ করা, বর্তমানে দিল্লিতে কর্মরত ‘নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরো’র (এনসিবি) আধিকারিক মনোজ মিশ্র জানাচ্ছেন, গেম খেলা ও কম্পিউটারে কাজ করার নামে বহু পড়ুয়ার মধ্যেও টর ব্রাউজ়ার ব্যবহারের ঝোঁক বাড়ছে। বাবা-মায়ের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে গেম খেলার নামে বিট কয়েন কিনছেন তাঁরা। তা দিয়েই বরাত দেওয়া মাদক ‘কুরিয়র’ মারফত পৌঁছে যাচ্ছে। মনোজের কথায়, ‘‘বিট কয়েন এক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা। এর দাম ওঠানামা করে। কখনও প্রতি কয়েনের মূল্য কয়েক লক্ষ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। লকডাউনের পরে একাংশ এই কয়েনের মাধ্যমে মাদকের অর্ডার দিচ্ছেন। অন্যেরা তাঁর থেকে কিনছেন। কুরিয়র সংস্থা চালু থাকায় লকডাউনে মাদক কারবার ধাক্কা খায়নি।”
পুলিশেরই সাইবার বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, এই শীতে মাদক কারবারের আরও একটি হাতিয়ার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ চালু করতে ১০ অঙ্কের ফোন নম্বরের প্রয়োজন হয়। অনলাইনে প্রচুর ‘ভার্চুয়াল মোবাইল নম্বর’ রয়েছে। তারই একটি ব্যবহার করে ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ চালু করা যায়। একটি ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’ (ওটিপি) যাওয়ার কথা ওই নম্বরে। যে সাইট থেকে ভার্চুয়াল নম্বর নেওয়া হয়েছে, সেখানে নম্বরটির উপরে ক্লিক করলেই ওটিপি-ও দেখা যায়।
‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্তও মনে করেন, কুরিয়র ধরে মাদক আটকানো সহজ নয়। তিনি জানান, ‘দ্য হিডেন উইকি ডট অর্গ’-এর মতো বহু ওয়েবসাইট সক্রিয়। টর ব্রাউজ়ার ব্যবহার করে সেখানে ঢুকলেই খোলাখুলি মাদকের কারবার চলতে দেখা যায়। সন্দীপবাবু বলেন, ‘‘কাউকে ধরা সম্ভব তাঁর আইপি অ্যাড্রেসের মাধ্যমে। টর ব্রাউজ়ার ব্যবহার করা মানে সেটাই লুকিয়ে ফেলা। তখন কেউ কলকাতা না কুয়েত থেকে কাজ করছেন, সেটা বুঝবেন কী ভাবে? অতএব কুরিয়র সংস্থা কে, জানবেন কী করে?”