প্রতীকী ছবি
কোভিড-পরিস্থিতিতে ক্রমশ আতঙ্ক জাঁকিয়ে বসছে জনমানসে। বয়স্কদের সংক্রমণ মানেই মৃত্যু, একঘরে হওয়ার আশঙ্কা, সন্দেহ-সংশয়-অবিশ্বাসের বাতাবরণ ঘিরে রেখেছে সমাজকে। এমনকি, হাসপাতাল-নার্সিংহোমের দ্বারস্থ হতেও দ্বিধা বোধ করছেন অনেকে। তথ্য না-জানায় দিশাহারা হয়ে পড়ছে সংক্রমিতের পরিবার। তাই আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এলেন শহরের বেশ কিছু কোভিডজয়ী এবং তাঁদের পরিবার। আক্রান্ত ও তাঁর পরিবারকে পরামর্শ দিতে এবং মনোবল বাড়াতে সাহায্য করবে কোভিডজয়ী এবং চিকিৎসকদের এই ফোরাম। যার পোশাকি নাম— ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক’।
আগামী পয়লা জুলাই পথ চলা শুরু হবে এই নেটওয়ার্কের। যার মূল উদ্দেশ্য করোনা-ভীতি দূর করা। কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা, স্বাস্থ্য ভবনের সঙ্গে যোগাযোগ করা, আতঙ্কিত না হয়ে পরিবারের পাশে থাকা— এ সব নিয়েই তথ্য জোগাতে হেল্পলাইন খুলছে এই ফোরাম। বাড়িতে থেকে করোনার চিকিৎসা চললে তাঁর খোঁজ রাখা এবং পরামর্শও মিলবে হেল্পলাইনে। আপাতত কলকাতা-হাওড়ায় এই কাজ শুরু হলেও ক্রমে সংলগ্ন জেলা, শহরতলি এবং উত্তরবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়বে এটি।
মে মাসে শ্বাসকষ্ট নিয়ে নার্সিংহোমে মাকে ভর্তি করিয়েছিলেন পেশায় মডেল মাধবীলতা মিত্র। মাঝরাতে খবর আসে, বৃদ্ধার রিপোর্ট পজ়িটিভ। কিন্তু অসুস্থ মাকে নিয়ে সরকারি কোভিড হাসপাতালে পৌঁছতেই কালঘাম ছুটে যায়। স্বাস্থ্য ভবনকে জানানো, অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা— দিশাহারা মাধবীলতার জানা ছিল না কিছুই। যার ফল, চূড়ান্ত হয়রানি। তাই ঠেকে-শেখা মাধবীলতা এখন চান, বিপদের মুহূর্তে রোগীর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক’-এর সক্রিয় সদস্য ওই মহিলা বলছেন, ‘‘এই সময়ে নেতিবাচক চিন্তায় ডুবে গেলে বিপদ। তার বদলে ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে যে কোভিডকে হারানো সম্ভব, সেই আশ্বাসই দিতে চাই।’’
এই ফোরামের পুরোভাগে রয়েছেন মোটিভেশনাল স্পিকার, সপ্তশৃঙ্গ ও সপ্ত আগ্নেয়গিরিজয়ী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত। চলতি মাসে তাঁর সত্তরোর্ধ্ব মামা আচমকাই জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন। অসুস্থ বৃদ্ধের করোনা পরীক্ষা কী ভাবে করানো সম্ভব, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন কী করে— এ সব চিন্তার সময়ে সহায় হয় পরিচিতদের দেওয়া তথ্য ও পরামর্শ। সে সবই এখন বাকিদের সঙ্গে ভাগ করতে চান সত্যরূপ। বলছেন, ‘‘মামার কারণে কোভিড নিয়ে যা জেনেছি, তা অন্যেরা জানলে বিপদের সময়ে উপকার পাবেন। কোভিড-ভীতি ও অবসাদ কাটাতেও মনোবল জোগাবে এই ফোরাম। সরকারের বর্তমান কোভিড-পরিকাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কাজ করব আমরা।’’
আরও পড়ুন: ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনেই মৃত্যু বৃদ্ধের
কী ভাবে? হেল্পলাইনে ফোন করলে করোনা চিকিৎসা এবং কো-মর্বিডিটি নিয়ে পরামর্শ দেবেন সরকারি হাসপাতালের নবীন চিকিৎসক এবং ইন্টার্নেরা। নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার জন্য থাকবেন কোভিডজয়ীরাও। উদ্যোক্তারা জানান, হাসপাতালে যাওয়ার আগে অনেকে পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার উপসর্গ থাকলেও হাসপাতালের নাম শুনেই ভয়ে কাঁপছেন। এর ফলে অনেক সংক্রমিত হাসপাতালে আসার দু’-তিন দিনের মধ্যে মারা গিয়েছেন। এ সব ক্ষেত্রে কোভিডজয়ীরাই হতে পারেন তুরুপের তাস। কোভিড-পর্বের শুরুতেই সংক্রমিত হওয়া, হৃদ্রোগ-চিকিৎসক অরিজিৎ ঘোষ এই ফোরামের সভাপতি পদে রয়েছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘করোনা ছোঁয়াচে হলেও মারণ নয়। মৃত্যুহার ২-৭ শতাংশ মাত্র। বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। করোনা-রোগীদের আলাদা থাকার প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু তা যেন তাঁর এবং পরিবারের পক্ষে পীড়াদায়ক না-হয়, সেটা দেখতে হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তাই করোনাকে সহজ ভাবে দেখতে এবং শেখাতে চাইছি।’’
ফোরামের সদস্য-তালিকায় রয়েছেন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী, বেলেঘাটা আইডি-র চিকিৎসক যোগীরাজ রায়, চিকিৎসক সায়ন্তন চক্রবর্তী, নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার, বেহালাবাদক পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, আইনজীবী অরিন্দম দাস প্রমুখ। একযোগে লড়াই করলে যে করোনাকে হারানো সম্ভব— এই বিশ্বাসটাই চারিয়ে দিতে চাইছেন তাঁরা।