পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
কলকাতায় পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরমগ্নতাকে ক্যামেরায় ধরেছিলেন (বাঁ দিকের ছবি) প্রণব বসু, পরে সে ছবি দেখে আনন্দিত সুরশিল্পী তাঁকে আশীর্বাদ করেন, এগিয়ে চলুক ক্যামেরার এই শিল্পকলা। উস্তাদ জাকির হোসেনকে ক্যামেরাবন্দি করলেন এক তুরীয় মুহূর্তে, এত পছন্দ হল তাঁর সেই ছবি, বললেন, একশোটা কপি তৈরি করো! সরোদে স্বরচিত রাগ বাজাচ্ছেন উস্তাদ আমজাদ আলি খান, যেন মগ্ন সাধনায়... তন্নিষ্ঠ সেই মুহূর্তগুলিও ধরা তাঁর ক্যামেরায়। আল্লারাখা গিরিজা দেবী বিজয় কিচলু কেলুচরণ মহাপাত্র বিরজু মহারাজ থাঙ্কমণি কুট্টি... কার ছবি তোলেননি! কলেজবেলার বন্ধু, আচার্য জয়ন্ত বসুর সূত্রে মার্গসঙ্গীতে দীক্ষা হয়েছিল প্রণব বসুরও— তবলাবাদনে। পরে ফোটোগ্রাফিই হল ধ্যানজ্ঞান, তবে অন্তরের সঙ্গীতমন্যতা ভিতর থেকে বলে দিত, শিল্পীর নিবেদনের ঠিক কোন মুহূর্তটি ধরতে হবে ক্যামেরায়।
আর নাট্যমঞ্চ? থিয়েটারে গত কয়েক দশকের স্মরণযোগ্য অগণিত মঞ্চকৃতি উদ্ভাসিত তাঁর লেন্সে। হাবিব তনভির জব্বর পটেল শ্যামানন্দ জালান বি ভি করন্থ কুলভূষণ খারবান্দা অমোল পালেকর শম্ভু মিত্র উৎপল দত্ত কুমার রায় বিভাস চক্রবর্তী উষা গঙ্গোপাধ্যায়-সহ তাবড় নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যমুহূর্তের (ছবিতে সখারাম বাইন্ডার-এর দৃশ্য) ছবি তুলেছেন, অমূল্য সংগ্রহ এক। থিয়েটারের ক্ষণিক নির্মাণকে আলোকচিত্রে দিয়েছেন চিরন্তন স্থিতি।
এক দিকে শিল্প-সংস্কৃতির উঠোনে অবাধ বিচরণ, অন্য দিকে প্রকৃতিপ্রেম। গলি থেকে রাজপথের জীবনচিত্র তুলে ধরা, আবার নিজের বাড়ির স্টুডিয়োয় ডুবে থাকা আদর্শ ‘টেবলটপ ফোটোগ্রাফি’র আলো তৈরিতে। ভারতের কত জায়গায় ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই, ডাল লেক থেকে মুন্নার, মেঘালয়, রাজস্থানের মান্ডওয়া। ‘ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি’ চর্চাতেও সিদ্ধহস্ত, অভিনেতা-আলোকচিত্রী সব্যসাচী চক্রবর্তী ছিলেন বন্যপ্রাণের ছবি তোলার যাত্রায় তাঁর সহচর। বিপন্ন বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ রক্ষায় সরকারি নানা প্রকল্প ও উদ্যোগেও ছিলেন জড়িয়ে। সিকিমের রাবাংলায় থিম পার্ক, দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানের কিউরেশন, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির হেরিটেজ ডকুমেন্টেশন, লেপচা জনজাতিদের উপর তথ্যচিত্র— বিপুল ও বিস্তৃত ছিল প্রণব বসুর কর্মবিশ্ব।
আগামী নভেম্বরে সত্তরে পা দিতেন, তার আগেই চলে গেলেন প্রণব বসু, গত ২৯ এপ্রিল। কর্মিষ্ঠ মানুষটি জীবনভর দিয়ে গিয়েছেন সংস্কৃতিজগৎকে, এ বার তাঁর স্মরণে এগিয়ে এসেছে বাংলা থিয়েটারের কর্মী, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংগঠন ‘সৌভ্রাতৃত্ব’। কোভিডকালে দুঃসময়ে থিয়েটারের কলাকুশলীদের সাহায্যকল্পে তৈরি হয় এই সংগঠন, আজ পর্যন্ত প্রায় ৪৬ লক্ষ টাকার অর্থসাহায্য নিয়ে নাট্যকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদেরই উদ্যোগ ‘প্রণব আলোয় থিয়েটার’— প্রণব বসুর ক্যামেরায় তোলা থিয়েটারের ছবি, সঙ্গে সঙ্গীত, নাচ, বন্যপ্রাণ ও পরিবেশের ছবিতে সেজে ওঠা প্রদর্শনী। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর নর্থ গ্যালারিতে উদ্বোধন আগামী ২৭ জুন সন্ধ্যা ৬টায়, থাকবেন কলকাতায় আমেরিকার মাননীয় কনসাল জেনারেল, শিল্পজগতের বিশিষ্টজন। প্রদর্শনী চলবে ৩ জুলাই পর্যন্ত।
পরম্পরা
আসছে ২৭ জুন, নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করের (ছবি) ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। বিশেষ অনুষ্ঠানের অর্ঘ্যে দিনটি উদ্যাপন করছে মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি। মঙ্গলবার রবীন্দ্রসদনে সন্ধ্যা ৬টায় শিল্পীর ছবিতে বিশিষ্টজনের পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন দিয়ে শুরু; প্রেক্ষাগৃহ প্রাঙ্গণে হবে প্রদর্শনী: অমলাশঙ্করের জীবন ও শিল্পের নানা মুহূর্তের ছবিতে সাজানো, বিশেষ আকর্ষণ শিল্পীর নিজের আঁকা ছবিও। দেখানো হবে অমলাশঙ্করকে নিয়ে তথ্যচিত্র। ডান্স কোম্পানি-র সদস্য শিল্পীরা নিবেদন করবেন নৃত্যনাট্য শবরী— মমতাশঙ্করের চিত্রনাট্য, পোশাক পরিকল্পনা ও পরিচালনায়; অতিরিক্ত সুর সংযোজন ও সঙ্গীতায়োজনে রাতুলশঙ্কর ঘোষ। “এর মধ্যে করোনাকালে তেমন ভাবে কাজ হয়নি, কোনও নৃত্য প্রযোজনার মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয়নি। উদয়শঙ্করের যে ঘরানা আমাদের অনুসৃত ধারা, তার নিবেদনে সন্ধ্যাটুকু সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াই লক্ষ্য,” জানালেন মমতাশঙ্কর।
স্মৃতিময়
গত বছর ১৯ মে প্রয়াত হন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের গীতিকার, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার ক’দিন আগেই কলকাতার প্রতিষ্ঠান বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর উদ্যোগে আন্তর্জালে বলেছিলেন ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। সেই কথোপকথন ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের স্মৃতিচারণ নিয়ে গত ৯ জুন এক তথ্যচিত্র উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। বললেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের লেখক এম আমীর-উল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান, ডেপুটি হাই কমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস-সহ বিশিষ্টজন; এই বাংলার বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতকিরণ দেব, সন্ধি মুখোপাধ্যায়, রাজশ্রী ভট্টাচার্য প্রমুখ, সভাপতি বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। আর ছিল রামেন্দু মজুমদারের আবৃত্তি, লাইসা আহমেদ লিসার গান।
জন্মদিনে
নান্দীকার-এর লোগো করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৬০-এর ২৯ জুন প্রতিষ্ঠা, এ বার পা চৌষট্টিতে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় দীপেন সেনগুপ্ত সত্যেন মিত্র অজয় গঙ্গোপাধ্যায় মহেশ সিংহ দীপক নন্দী চিন্ময় রায় প্রমুখের উপস্থিতিতে দিনগুলি উজ্জ্বল বঙ্গস্মৃতিতে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তী, পরে স্বাতীলেখা চট্টোপাধ্যায়ের যোগদানে ক্রমাগত সৃষ্টিশীল, ছয় দশক ধরে ঋদ্ধ করেছে থিয়েটারকে। এক থেকে বারো, মানুষ, রাণী কাদম্বিনী, মাধবী-র মতো সাম্প্রতিক কাজগুলি মঞ্চসফল; সল্টলেকে দলের নতুন আস্তানার প্রস্তুতি শেষের পথে। জন্মদিনে ২৯ জুন অ্যাকাডেমিতে সন্ধে সাড়ে ৬টায় পাঞ্চজন্য-র অভিনয়, নতুন আঙ্গিকে পরিচালনা করছেন সোহিনী সেনগুপ্ত, অভিনয়ও করছেন গান্ধারীর ভূমিকায়।
পরিবেশ নিয়ে
পরবর্তী প্রজন্মের হাতে থাকুক সুস্থ সুন্দর পৃথিবী— এই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে রাসবিহারী ‘সেন্টার ফর ইকোলজিক্যাল মুভমেন্ট’ (সিইএমও)। বৃক্ষরোপণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে সচেতনতা, বাঘ বাঁচাতে পদযাত্রা, ‘নেচার ক্লাব’ গড়ে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করা, বায়ো-টয়লেট তৈরি... এমন বহু উদ্যোগ করেছে তারা বিগত বছরগুলিতে— মহানগর থেকে মফস্সলে, গ্রামে। অতিমারিতে কিছু দিন থমকে ছিল কাজ, ফের নবোদ্যমে শুরু। ৩০ জুন রোটারি সদনে সকাল ১০টায় তাদের আয়োজনে আন্তঃস্কুল বিতর্ক, আফ্রিকা থেকে ভারতে চিতা নিয়ে আসা নিয়ে। দুপুর ২টোয় সুন্দরবন ও ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনায় বন্দনা শিব সুগত হাজরা সৌমিত্র দাশগুপ্ত প্রণবেশ সান্যাল অতনু রাহা-সহ বিশিষ্টজন।
খেলার ছবি
স্পোর্টস ফিল্ম-এর আলাদা কদর দর্শকমহলে, নানা দেশে নানা সময়ে তৈরি হয়েছে জনপ্রিয় সব স্পোর্টস ফিল্ম। কিন্তু কলকাতায় এক গুচ্ছ স্পোর্টস ফিল্ম নিয়ে একটা উৎসব, এমন বোধহয় হয়নি আগে। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া (এফএফএসআই)-এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখার উদ্যোগে গত ২২ জুন থেকে নন্দন-৩’এ চলছে ‘ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রীড়া চলচ্চিত্র উৎসব’, চারটি দেশের বারোটি চলচ্চিত্র নিয়ে, রোজ দুপুর ১টা, বিকেল ৩টে ও সাড়ে ৪টায়, আগামী কাল পর্যন্ত। রয়েছে লাহোর, হোম গেম, এগারো, ইনভিকটাস, দামাল, সুদানি ফ্রম নাইজিরিয়া, তিকি তাকা, লড়াই, দ্য মির্যাকল অব বার্ন, ৮৩-র মতো ছবি।
ভুলে না যাই
দশ বছর হয়ে গেল শিল্পী শানু লাহিড়ীর প্রয়াণের। তারও বড় কথা, বহু দিন হল এ শহরে তাঁর চিত্রকৃতি নিয়ে প্রদর্শনী হয়নি কোনও, শহরের শিল্প-পরিসরগুলিতে আলোচনা হয়নি তাঁকে নিয়ে। গত ১৬ জুন সে কাজটিই করল পার্ক স্ট্রিটের গ্যালারি আর্ট ফ্রিকোয়েন্সিজ়— ‘শানু লাহিড়ী: ট্রানজ়িশনস অ্যান্ড ইন্টারসেকশনস’ প্রদর্শনীর মাধ্যমে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যা: শিল্প-ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতার অন্তরঙ্গ কথনে উঠে এল শিল্পীর জীবনকৃতি, শানু লাহিড়ী ও তাঁর সমসাময়িক নারী চিত্রশিল্পীদের কাজের পরিপ্রেক্ষিত, বিদেশে শিল্পচর্চা, দেশে ফিরে নিজেদের কাজে নতুন দিক-আঙ্গিকের এষণা। আশির দশকে এ শহরের দেওয়াল সেজে উঠেছিল শিল্পীর নেতৃত্বে অনবদ্য ম্যুরালে (নীচের ছবি), ই এম বাইপাসে পরমা আইল্যান্ডে ছিল তাঁর স্থাপত্য। সেই সবই আজ অতীত। প্রদর্শনী মনে করিয়ে দেয়, যেন ভুলে না যাই।
শিল্পের পাঠ
ভারতীয় শিল্পের মর্মানুসন্ধান— ‘অ্যাপ্রিসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান আর্ট’। এই ইংরেজি শিরোনামে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি পাঠক্রম পরিচালনা করে আসছে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক। প্রতিষ্ঠানের মিউজ়িয়ম ও আর্ট গ্যালারিটির শিল্পসম্ভার (ছবিতে গ্যালারির সংগ্রহের একটি আইভরি মিনিয়েচার চিত্র) বিষয়ে এ শহরের শিল্পরসিকমাত্রেই বিলক্ষণ অবগত, এমনকি এই কোর্সটি সম্পর্কেও আগ্রহ ও অনুসন্ধান কম নয়। বারো মাসের পাঠক্রমটি নতুন মোড়কে শুরু হচ্ছে আবারও, আগামী ৩ জুলাই থেকে। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী, শিল্প-ঐতিহাসিক, কলা-সমালোচক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও সংগ্রহশালা-বিশেষজ্ঞরা ক্লাস নেবেন; থাকবে ছবি ও ভিডিয়ো সহযোগে বক্তৃতা, কর্মশালা— জানা যাবে শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব, ভারতে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের কালানুক্রমিক ইতিহাস, ম্যুরাল ও মিনিয়েচার চিত্র, লোকশিল্প নিয়ে। বিশদ তথ্য জানা যাবে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট (www.sriramakrishna.org) থেকে।
অন্য রূপে
১০৩তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হল, বাঙালির প্রিয় কণ্ঠের। প্রতি বছর ১৬ জুন ঘিরে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে ব্যতিক্রমী নানা উদ্যোগ করে থাকে ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি’। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি, স্মরণ কমিটির ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৬ জুন প্রকাশিত হয়েছে অন্য রকম প্রয়াস, ‘কবিতায় হেমন্ত’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রবীণ-নবীন কলমে লেখা একগুচ্ছ কবিতা পাঠ করেছেন বাচিক শিল্পী দেবাশিস বসু। আরও কিছু কবিতা, সেই সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লেখা গল্প পাঠের রেকর্ডিংও সম্পন্ন হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটির উদ্যোগে, জানালেন সম্পাদক সৌম্যেন অধিকারী— ‘কবিতায় হেমন্ত’-র সামগ্রিক পরিকল্পনা, বিন্যাস ও আবহসঙ্গীত তাঁরই। নতুন প্রজন্মের কাছে শিল্পীকে চেনানো, নবরূপে।