ইচ্ছেপূরণের আশায় তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা গ্রামে ও শহরতলিতে আকছার ঘটেছে। প্রতীকী ছবি।
বিজ্ঞানমনস্কতা, না কি অতিপ্রাকৃতিক ধ্যানধারণা? যুক্তিবাদ, না কি কালো জাদু-বশীকরণ? বিজ্ঞানের সংস্কৃতি, না কি অবৈজ্ঞানিক সমাজব্যবস্থা?
তিলজলায় প্রতিবেশীর সাত বছরের মেয়েকে যৌন নির্যাতনের পরে খুনের ঘটনায় ধৃত অভিযুক্তদাবি করেছে, সন্তান লাভের আশাতেই নাকি এক তান্ত্রিকের পরামর্শে সে ওই কাজ করেছে। তার পরেই উঠেছে এই সমস্ত প্রশ্ন। ট্রেনে, বাসে ভবিষ্যৎ বদলের বিজ্ঞাপন তো রয়েইছে, এমনকি, অতিলৌকিক সিনেমা-ধারাবাহিক, টিভিতে তান্ত্রিকের কালো জাদুর মহিমা ব্যাখ্যা বা বশীকরণের বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রদানের চেষ্টা মানুষের সুস্থ চিন্তাভাবনাকে গ্রাস করছে কি না, উঠেছে সেই প্রশ্নও। যার জেরে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যকেও। নতুন ঘরানার কিছু বইয়ের মাধ্যমে কুসংস্কার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন অনেকে।
ইচ্ছেপূরণের আশায় তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা গ্রামে ও শহরতলিতে আকছার ঘটেছে। ঘটে চলেছে। গণেশমূর্তির দুধ খাওয়া বা ভাগ্য বদলাতে আংটি ধারণ— এ সবই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনন এবং অবৈজ্ঞানিক সমাজব্যবস্থার উদাহরণ বলে মনে করছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’-এর রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মিলনচন্দ্র গায়েন। তাঁর মতে, ইহকাল-পরকাল, জ্যোতিষ, ভূত-প্রেতের ধ্যানধারণাই স্বাভাবিক বিজ্ঞানমনস্ক তাকে হারিয়ে দিচ্ছে।
সিনেমা, সাহিত্যেও সেই অতিলৌকিক দৃশ্য এবং পটভূমিকার ছড়াছড়ি। টিভি চ্যানেলে বসা তান্ত্রিকের পাঁচ মিনিটেই সমস্যা সমাধান বা বশীকরণের আশ্বাসেঅতি শিক্ষিতেরাও প্রভাবিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তাঁর মতে, সিনেমা-ধারাবাহিকে বিশেষ কোনও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন বা অতিলৌকিক কাণ্ডকারখানা কোথাও না কোথাও জনমনকে প্রভাবিত করে। ট্রেনে-বাসের বিজ্ঞাপনও একই কাজ করে। যা কুসংস্কারের পথকে সুগম করছে। যদিও টিভি ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য লেখিকা তথা রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের পাল্টা যুক্তি, ‘‘জীবনের সব কিছু বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করা যায় না। তা হলে তো কল্পনা বলেই কিছু থাকে না। টিভি সিরিয়াল ও সাহিত্যকে বয়কট করলেই অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে, এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন? আসলে ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে মানুষ অলৌকিকতাকে মনে স্থান দেয়। সেই বিশ্বাস উপড়ে ফেলতে গেলে বিজ্ঞানমনস্ক মন তৈরির পথে কাজ করতে হবে।’’
এ ক্ষেত্রে সাহিত্যও ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে নেট-দুনিয়ায় তোপ দাগছেন অনেকে। তাঁদের মতে, এ ভাবেই সাহিত্যের হাত ধরে বিজ্ঞান থেকে দূর সরে যাচ্ছে বর্তমান জনমানস, এমনকি, পরবর্তী প্রজন্মও। অথচ, জনপ্রিয়তার স্বাদ পেয়ে কিছু লেখক, প্রকাশক সেই কালো জাদু, তন্ত্রমন্ত্র, নরবলির অতিপ্রাকৃতিক দুনিয়াকে ঘিরেই বার করছেন গল্প-উপন্যাস। স্বপ্নময়ও বলছেন, ‘‘আজকাল অনেক লেখায় তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম ফলদায়ক বলে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সমাজে তার প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, সাহিত্য ও সমাজের আদানপ্রদান এ ভাবেই হয়ে থাকে। তবে, বইয়ের পাতায় কালো জাদুর গল্প যদি অলৌকিক বলে মনে করানো হয়, তা হলে এই সমস্যা হয় না। কিন্তু, তা বেশি বাস্তববাদী আঙ্গিকে লেখা হলে পাঠক সেটাকেই সত্যি বলে ভাবতে শুরু করতে পারেন।’’
আবার উল্টো মতও আছে। সমালোচকদের এক হাত নিয়ে পাঠকদের একাংশ বলছেন, ‘‘কে, কী গ্রহণ বা বর্জন করবেন, তা একান্তই ব্যক্তিগত যুক্তিবোধের উপরে নির্ভর করছে।’’ কারও ব্যঙ্গোক্তি, ‘‘তা হলে ঠাকুরমার ঝুলি, রাক্ষসখোক্কস, তারাশঙ্কর, হ্যারি পটার, লর্ড অব দ্য রিংগস— সব কিছুই বাদ দিতে হয়!’’ তিলজলা-কাণ্ডে ধৃত বিহারের বাসিন্দা বাংলা সাহিত্য পড়ত কি? সে প্রশ্নও উঠেছে। বাংলা ভাষায় হালফিলের তন্ত্র-বইয়ের অন্যতম লেখক-প্রকাশক অভীক সরকার বলছেন, ‘‘তিলজলার কারণ হিসাবে সাহিত্যকে টেনে আনা পরিস্থিতির অতি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। এটা তো ইতিহাসের প্রথম নরবলি নয়। সেই সব অপরাধের জন্য তবে কাকে দুষবেন? সমাজের অন্ধকার দিক নিয়ে না লেখা গেলে তো শার্লক হোমস, হ্যারি পটারকেও নিষিদ্ধ করতে হয়!’’
সাহিত্যকে কাঠগড়ায় তোলার বিপক্ষে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর যুক্তি, ‘‘যারা এই ধরনের ভয়াবহ, পৈশাচিক অপরাধ করতে পারে, তাদের সঙ্গে সাহিত্য বা বইপত্রের আদৌ কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে হয় না। সাহিত্যে তো খুন-জখমও থাকে। তা হলে কি ধরে নিতে হবে, পাঠকেরা বই পড়েই খুনি হয়ে উঠবেন? কে কোন বুজরুকের পাল্লায় পড়ে কী অপরাধ করল, তার জন্য সাহিত্যকে কাঠগড়ায় তোলা উচিত বলে মনে করি না। সাহিত্য যে শ্রেণিরই হোক, তাকাউকে অপরাধী করে তোলে না বলেই আমার বিশ্বাস।’’