ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিপদে পড়েছেন একাকী প্রবীণদের অনেকেই। নিজস্ব চিত্র
ঝড় থেমে গেলেও পানীয় জল আর বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি শহরের বহু এলাকায়। ফোনের নেটওয়ার্কও বেসামাল। যার জেরে বিপদে পড়েছেন অসংখ্য প্রবীণ নাগরিক। বিদ্যুৎ না-থাকায় ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়ে অথবা নেটওয়ার্কের সমস্যায় বহির্জগতের সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন। কলকাতার পাশাপাশি নিউ টাউন ও রাজারহাটেও থাকেন এমন বহু একা প্রবীণ-প্রবীণা। বাইরে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না এঁদের অনেকেই।
সুদূর রাজস্থানের মরুদেশে বসে এখনও সেই গর্জনশীল প্রলয় বাতাসের ঝাপটা টের পাচ্ছেন লিপিকা দে। পেশায় কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ওই প্রবাসী বাঙালিনী শনিবার কথা বলছিলেন যোধপুর আইআইটি-র ক্যাম্পাস থেকে। আমপান থামার দু’দিন বাদেও গরফার বাসিন্দা মা-বাবার সঙ্গে কথা হয়নি তাঁর। জীবনের সব নিশ্চিন্তি, পরিতৃপ্তির বোধ যেন উবে গিয়েছিল লহমায়।
শেষ বার যখন তাঁদের সঙ্গে কথা হয়, তখন প্রলয় নাচন চলছে কলকাতায়। গরফার ফ্ল্যাট নিষ্প্রদীপ। “কী গো, তোমাদের ফ্ল্যাটে জল ঢোকেনি তো? দেখো, অন্ধকারে পড়েটড়ে যেও না,” বলতে বলতেই লাইন কেটে যায়। তার পরে ঝাড়া দু’দিন লাইন পাননি লিপিকা।
একই দশা অস্ট্রেলিয়ার পারথে কর্মরত ভাস্কর পালের। যাদবপুরের রিজেন্ট এস্টেটে তাঁর মা-বাবার ফ্ল্যাটেও নেটওয়ার্ক নেই। কথা বলতে গেলে সুলেখা মোড় পর্যন্ত হেঁটে আসতে হচ্ছে। স্মৃতিভ্রংশে কাবু ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাবার পক্ষে সেটা অসম্ভব। বিদ্যুৎহীন বহুতলের ফ্ল্যাটে পানীয় জলটুকুর সংস্থান কী করে হবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই ঘুম উড়ে যাচ্ছিল প্রবাসী পুত্রের। জনৈক পড়শির উদ্যোগে এ দিন দুপুরেই জেনারেটর ভাড়া করে পাম্প চালানোর একটা ব্যবস্থা করা গিয়েছে বলে খবর মিলেছে।
লিপিকার মা-বাবার ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ ফিরেছিল শুক্রবার। কিন্তু সেখানে এখন পাম্পের লোড সামলানো যাবে না বলে পইপই করে জানিয়ে গিয়েছেন বিদ্যুৎকর্মীরা। তবে শত দুর্ভোগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যেও কয়েক জন পড়শির সহৃদয়তাই যে এত বড় সঙ্কটে মা-বাবার সহায় হয়েছে, তা বারবার বলছিলেন তিনি। “আমরা তো এ পাড়ায় বড় হইনি।
পড়শিরাও তত চেনা নন। কিন্তু ওঁরাই চারতলার লিফটবিহীন ফ্ল্যাটে জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেছেন।” গড়িয়ায় লিপিকার কানাডাবাসী এক বন্ধুর মা-বাবার ক্ষেত্রেও পড়শিরাই ত্রাতা হয়ে দেখা দিয়েছেন।
বেহালার শকুন্তলা পার্কের বাসিন্দা, সত্তরোর্ধ্ব অনিলকুমার ঘোষ অবশ্য এত বড় দুর্যোগে দিন দুয়েক বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যাটুকু অস্বাভাবিক নয় বলেই মেনে নিয়েছিলেন।
তবে মুম্বইয়ের পওয়াইয়ের বাসিন্দা, ছেলে অমিতাভের কাছে তাঁর মৃদু অভিযোগ, বিপদের সময়ে পুরসভা বা কলকাতা পুলিশের বয়স্কদের হেল্পলাইন আর একটু সক্রিয় থাকতে পারত।
মুম্বইয়ের ব্যাঙ্ক-কর্তা রাজদীপ চক্রবর্তীর মা-বাবার কামালগাজির বাড়িতেও বিদ্যুৎ আসেনি এখনও। ফোনেও কথা বলা যাচ্ছে না। পাম্প চলছে না। একই অবস্থা ফ্রান্সের মেটজ়-এর বাসিন্দা সুজয় সরকারের মা-বাবারও। সেখান থেকেই পরিচিতদের ফোন করে নরেন্দ্রপুরে ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে পানীয় জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘ফোনে লাইন পাচ্ছি, তবে সাধ্যসাধনা করে। আমপানের পর থেকে এমনই চলছে।’’
কলকাতায় যা-ও বা যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে, ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ বা হাসনাবাদে থাকা মা-বাবারা যেন রাতারাতি ভিন্ গ্রহের বাসিন্দা। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো সেখানে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সঙ্কটই আবার কাউকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। বেঙ্গালুরুর শ্রেয়সী দস্তিদার বেহালায় মা-বাবাকে ফোনে পাননি দু’দিন। পরে জেনেছেন, মা নিজে মাথা খাটিয়ে গাড়ির ব্যাটারি থেকে ফোনে চার্জ দেওয়ার কৌশল রপ্ত করেছেন। ভুক্তভোগী শ্রেয়সী এখন কলকাতা-মফস্সলের নানা এলাকার বন্ধুবান্ধবদের জুটিয়ে বিচ্ছিন্ন বয়স্ক নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজে এগিয়ে আসার ডাক দিচ্ছেন। এগিয়েও এসেছেন অনেকে।
লিপিকার উপলব্ধি, “কলকাতার বরাবরের পাড়াতুতো সম্প্রীতি এখনও মুছে যায়নি। অজানা সঙ্কটের আকালেও সেটাই বড় ভরসা।”