জলমগ্ন বই পাড়া। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
উড়ে গিয়েছে দোকানের চাল। রাস্তার উপর জলে ভাসছে রং-বেরঙের মলাট, বই।
শুধু দোকানই নয়, গোডাউনের শক্তপোক্ত দরজা-জানলাও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে ঝড়। মেঝেতে থই থই করছে জল। তাকে সযত্নে রাখা বইগুলো এখন মণ্ড পাকিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
যে কাগজগুলো দিয়ে তৈরি হত নতুন বই, সেগুলোই ভেঙে পড়া নৌকার পালের মতো ভেসে গেল জলে। জমজমাট বইপাড়ার গুমটি দোকানগুলো যেন এক একটা ধ্বংসস্তূপ!
কোনওটার শুধু দেওয়ালটুকু আছে, আবার কোনটা প্রায় নিশ্চিহ্ন। এশিয়ার বৃহত্তম বইয়ের বাজারে এখন যে দিকেই চোখ যায়, সে দিকেই শুধু থমথমে নিস্তব্ধতা। যেখানে দু’ধারের ফুট জুড়ে শুধু ভেসে আসত বই বিক্রেতাদের ডাক, হরেক রকম বইয়ের নাম, আজ সেখানে শুধু সব কিছু ঠিক হওয়ার শব্দহীন অপেক্ষা।
আমপানের পর কলেজ স্ট্রিট। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
কলেজ স্ট্রিটের প্রাণবন্ত চেহারাটা এ ভাবেই বদলে দিয়েছে আমপান (প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন)। কয়েক ঘণ্টার ঝড় পুরোপুরি তছনছ করে দিয়েছে বইপ্রেমীদের সাধের কলেজ স্ট্রিটকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রায় ৬০ লক্ষ টাকার বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমপানের তাণ্ডবে।
লকডাউনের জেরে আগেই অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বইপাড়ার ব্যবসা। তার মধ্যে আমপান যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। বই-বিক্রেতাদের একাংশ প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ওই বইগুলোকেই কোনও রকম শুকিয়ে কার্যত অর্ধেক দামে বিক্রি করে কিছুটা আয়ের পথ দেখার চেষ্টা করছেন। ব্যবসায়ীদের অনেকেই আবার বইপাড়ার মায়া ত্যাগ করে সব্জির ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছেন। কারণ, এই ক্ষতি সামলানোর মতো সামর্থ তাঁদের নেই।
আরও পড়ুন: আমপান-ধ্বস্ত কবর জুড়ে মৃত গাছেরা
গত বুধবারের ঝড়ের রাত কাটতে না কাটতেই বিধ্বস্ত কলেজ স্ট্রিটের ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বইপ্রেমীদের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াতে চান। লক্ষ্য একটাই— ভালবাসার বইপাড়াকে চেনা ছন্দে ফিরিয়ে আনা। যে ভাবেই হোক আবার হাসি ফোটানোর চেষ্টা বইপাড়ার মুখে। লকডাউন তো কি, সাধের বই ও বইপাড়াকে বাঁচাতে এ বার অস্ত্র ডিজিটাল ব্যবস্থা— ‘মুখবই’। ফেসবুকের সাহায্যেই নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। ‘বই মরে না’ তাদের মধ্যে অন্যতম। বইঘর ডট ইন এবং বোধশব্দের যৌথ প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত বইগুলি বিক্রি করে সেই টাকা তুলে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট বইগুলির বিক্রেতা ও প্রকাশকদের হাতে। এই বইগুলি পাওয়া যাবে বইঘর ডট ইন-এর ওয়েবসাইটে। উদ্যোক্তাদের অন্যতম সুস্নাত চৌধুরী বললেন, “ইতিমধ্যেই প্রচুর মানুষ আমাদের এই উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন। অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বই কেনার ইচ্ছা জানিয়ে। আমিও কলেজ স্ট্রিটে যাচ্ছি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের এই উদ্যোগের ব্যাপারে জানানোর জন্য। তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক।’’
আরও পড়ুন: বাড়ছে সরকারি বাস, আজ থেকে পথে অটোও
বইঘর ডট ইনের কর্ণধার তুহিন মল্লিক জানান, “এই উদ্যোগে কোনও বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতির কথা না ভেবেই আছি। উদ্দেশ্য একটাই, ক্ষতিগ্রস্ত বিক্রেতা এবং প্রকাশকদের পাশে দাঁড়ানো। আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত বইগুলি সবটা বিক্রি না হলেও কয়েকটিও যদি বিক্রি হয়, তাতেও বিক্রেতা-প্রকাশকদের কিছুটা সাহায্য হবে। লকডাউনে যে হেতু মানুষ বই কিনতে আসতে পারবেন না, তাই আমার মনে হল বইঘর ডট ইন সে ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।” তিনি আরও জানান, আপাতত প্রকাশক এবং বিক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত বইগুলির একটি তালিকা তৈরি করছেন। তা হাতে পেলেই জুন মাসে প্রথম সপ্তাহ থেকে বিক্রি করা শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে বইগুলির দাম হবে মুদ্রিত মূল্যের অর্ধেক বা তারও কম। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকেই ইতিমধ্যে বইয়ের অর্ডার আসা শুরু হয়েছে।
কলেজ স্ট্রিটের অনেক প্রকাশক বা বিক্রেতার কাছে বই তাঁদের সন্তানের মতো। কাগজ কেনা থেকে বাঁধানো— সবটাই তিলে তিলে হয়ে ওঠে তাঁদেরই উৎসাহে। তাই ভালবাসার বইগুলিকে কতগুলি ভিজে কাগজের মণ্ড হিসাবে কেজি দরে বিক্রি করতে তাঁরা নারাজ। এই উদ্যোগে প্রকাশকরাও তাই কিছুটা আশার আলো দেখছেন। ভাষালিপি প্রকাশনার নবনীতা সেনের কথায়, “তেরো বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এত বড় দুর্যোগ কখনও দেখিনি। আর্থিক যা ক্ষতি হয়েছে, তা হয় তো এ ভাবে পূরণ হবে না। তবুও বইগুলো কেউ পড়লে বা নিজের কাছে সেই বিধ্বংসী রাতের স্মারক হিসাবে রাখলেও আমাদের শ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।”
একটি বেসরকারি আইটি সংস্থায় কর্মরত অর্পণ গুপ্তের বইপাড়ায় আনাগোনা বহু দিনের। প্রিয় জায়গার এই দুর্দিনে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “পুরনো বই তো আমরা অনেকেই পড়ি। তা হলে এই বইগুলোই বা কিনব না কেন? বই আমাদের সব সময়ের সঙ্গী। এ বার আমাদের পালা সঙ্গে থাকার। কোনও বই আবার একেবারেই পড়া না গেলে, তা থাকবে সেই দুর্যোগের স্মারক হয়ে।”
অর্পণের সঙ্গে একমত খড়্গপুরের বাসিন্দা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র অনুজিৎ মাইতি। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “মানবতার খাতিরে আজ আমাদের বইপাড়ার পাশে থাকা উচিত। এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই আবার সুদিন ফিরিয়ে আনবে। আমি ইতিমধ্যেই কয়েকটি বইয়ের তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু অপেক্ষা হাতে পাওয়ার।”
তেহট্টের দীলিপ মণ্ডলের কাছে বইপাড়া মানেই নস্টালজিয়ার মেলা। তাঁর কথায়, “ছাত্রজীবনটা আমার ওই চত্বরেই কেটেছে। অনেক কিছু পেয়েছি ওই জায়গাটা থেকে। তাই এই দুঃসময়ে কিছুটা ফিরিয়ে দিতে পারলে ভাল লাগবে। বই তো বই-ই হয়। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার দাম কমে না।”
বইপাড়ায় সুদিন ফেরাতে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। আশা, বইয়ের প্রতি ভালবাসাই আবার হাসি ফোটাবে বইপাড়ার মুখে।