উঁকিঝুঁকি। মঙ্গলবার দেশপ্রিয় পার্কে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
মহাসপ্তমীতে অন্যান্য জায়গার মতো সেখানেও দেবীর পুজো হয়েছে যথানিয়মে। ষোড়শোপচারে। ধুমধাম করেই। কিন্তু এ যেন দুর্গার বন্দিদশায় বন্দনা!
দেশপ্রিয় পার্কের ‘সব চেয়ে বড়’ দুর্গাকে ঘিরে বিপর্যয়ের পরে লালবাজারের পুলিশকর্তারা বাইরে থেকে প্রতিমা দর্শন বন্ধ করে দিয়েছেন ঠিকই। তবে ‘বড়’ দুর্গার আড়ালে থাকা ‘ছোট’ দুর্গার যথাবিধি পুজো হয়েছে মঙ্গলবার।
অবশ্য বড় দুর্গার মূর্তি যাতে কোনও মতেই দেশপ্রিয় পার্কের বাইরে থেকে দেখা না-যায়, সেই ব্যবস্থাও করেছে পুলিশ। পার্কের চার দিকে ৩০ ফুটেরও বেশি উঁচু করে নীল কাপড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে কোনও অবস্থাতেই উঁকিঝুঁকি মেরে বড় দুর্গা দেখা না-যায়। এ ভাবেই প্রায় গুহাবন্দি হয়ে সপরিবার দেবী দুর্গা পুজো পেয়েছেন এ দিন।
যদিও পুজোপ্রেমীদের দমিয়ে রাখতে এমন সব আবরণ যে তুচ্ছ, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বারবার। পঞ্চমীর দিন প্রতিমা দর্শন বন্ধ বলে ঘোষণা করার পরেই উত্সাহী দর্শকেরা রেলিংয়ে উঠে মোবাইলে ছবি তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ষষ্ঠী, এমনকী সপ্তমীতেও মরিয়া চেষ্টার সেই ছবিটা ছিল প্রায় একই।
ম্যাডক্স স্কোয়ারে বসে গড়িয়ার শ্রীপর্ণা তালুকদার বারবার ফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন বন্ধুর কাছে, ‘‘হ্যাঁ রে, কোনও চান্সই কি নেই বড় দুর্গা দেখার?’’ উত্তরে অবশ্য সদর্থক কিছুই শুনতে পেলেন না তিনি। ষষ্ঠীর রাত প্রায় আড়াইটেতেও গড়িয়া থেকে হাজরা যাওয়ার বাসে ঠাসা ভিড়। দেশপ্রিয় পার্ক আসতেই বাসের ভিতরে গুনগুনিয়ে উঠছে উৎসাহ: ‘ওই দেখ, একটু দেখা যাচ্ছে রে’, ‘দেখ না ছবিটা ওঠে কি না’। কাল হয়তো অনুমতি মিলবে, এমন আশা ছাইচাপা আগুনের মতো বারবার উস্কে উঠছে কৌতূহলীদের মনে।
সোমবার দেশপ্রিয় পার্কের বড় দুর্গার মুখ ঢেকে দেওয়া হলেও লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতীর মূর্তি ঢাকা হয়নি। ফলে সে-দিনও পার্কের রেলিং ধরে বা পার্কের ধারের গাছে চড়ে ওই সব মূর্তি দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে অনেককে। তাঁদের চেষ্টা দেখে পার্কের পাশে ফুটপাথেও ঢল নামে উৎসাহীদের। তা দেখে এ দিন আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি পুলিশ। অতি-উৎসাহীদের আটকাতেই পার্কের চার পাশ নীল কাপড়ে মুড়ে ফেলার ব্যবস্থা হয়।
মহাসপ্তমীর সকাল থেকেই দেশপ্রিয় পার্কের আশপাশ থেকে ভিড় সরাতে ব্যস্ত ছিল পুলিশ। ঘটনাস্থলে ছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষও। বিকেলে ওই পার্ক লাগোয়া পুজো মণ্ডপগুলির ভিড় সামলাতে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।
বিপত্তির পরে দেশপ্রিয় পার্কের পুজো নিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সেখানে পুলিশও আপাতত তৎপর। কিন্তু শহরের অন্য যে-সব পুজো উদ্যোক্তারা নিয়ম মানেননি, করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, কেনই বা সেই সব পুজো এখনও বন্ধ হচ্ছে না— উঠছে সেই প্রশ্ন। একটি পুজোর এক কর্তা বললেন, ‘‘কলকাতা পুরসভা এ বার এমন একটি পুজো কমিটিকে পুরস্কার দিয়েছে, যারা কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পুজো করেনি।’’
শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ, পুর-বিধি না-মেনে পুজো করা হলে তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব। সেই প্রভাবের কাছে মাথা নত করেছেন লালবাজারের কর্তারাও। ফলে শহর জুড়ে পুর-বিধির তোয়াক্কা না-করে পুজো করার প্রবণতা বাড়ছে। ছোট-বড় সব পুজোর উদ্যোক্তারা মেনে নিচ্ছেন, ঝান্ডার রং-ই যে পুজোর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে, সেটাই এখন ‘সব চেয়ে বড় সত্যি’। সেটাই এখন ‘সব চেয়ে বড় সত্যি’।