—প্রতীকী চিত্র।
দেশি না বিদেশি, কোন ইনজেকশন সদ্যোজাতদের চোখের রেটিনা বাঁচাতে বেশি উপযোগী, তা নিয়ে টানাপড়েনের জেরে গত বছরের মার্চ থেকে কলকাতার ‘রিজিয়োনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি’ (আরআইও)-তে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইনজেকশন কেনার প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে। পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কেন্দ্রের দেওয়া ‘জাতীয় অন্ধত্ব নিবারণ প্রকল্প’-এর এক কোটি টাকা। আরআইও ওই টাকার ‘ইউটিলাইজ়েশন সার্টিফিকেট’ দিতে পারছে না বলে কেন্দ্র পরবর্তী টাকাও আটকে রেখেছে।
স্বাস্থ্য ভবনে দফায় দফায় বৈঠক করে, একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে ও কেন্দ্রের সঙ্গে ভিডিয়ো বৈঠক করেও ইনজেকশনের দ্বন্দ্ব মেটানো যায়নি। এর জেরে সদ্যোজাতদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ইনজেকশন প্রায় ১১ মাসের উপরে কেনা হয়নি। সব মিলিয়ে চাপে আরআইও তথা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে র্যানিবিজ়ুম্যাব ইনজেকশন। এটি মূলত রেটিনায় শিরার অবাঞ্ছিত স্ফিতি নিয়ন্ত্রণ করে। রেটিনা সংক্রান্ত ‘এজ রিলেটেড ম্যাকুলার ডিজেনারেশন’, ‘ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি’র মতো রোগের পাশাপাশি সদ্যোজাতদের ‘রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিয়োরিটি’ বা আরওপি রোগে এটি অত্যন্ত উপযোগী।
স্বাস্থ্য দফতর অনেক আগে থেকেই সদ্যোজাতদের রেটিনার চিকিৎসায় ‘প্রি-ফিল্ড র্যানিবিজ়ুম্যাব’ ইনজেকশন ব্যবহার করত। এই ধরনের ইনজেকশনের সিরিঞ্জে আগে থেকেই ওষুধ ভরা থাকে, ভায়াল থেকে সিরিঞ্জে টানতে হয় না। একটি মাত্র বিদেশি সংস্থা এই ইনজেকশন বিক্রি করে। তাদের থেকেই সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর মারফত তা সরকারি ক্ষেত্রে সরবরাহ হত। এক-একটি সিরিঞ্জের দাম প্রায় ১৬ হাজার টাকা! ২০২২ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও ‘ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অব ইন্ডিয়া’ একটি দেশি সংস্থাকে ওই ইনজেকশন তৈরির অনুমোদন দেয়। তবে তাদের ইনজেকশন ‘প্রি-ফিল্ড’ নয়। অর্থাৎ, ওষুধ থাকে ভায়ালে। সিরিঞ্জে তা ভরে নিতে হয়। এক-একটির দাম বিদেশি সংস্থার ইনজেকশনের প্রায় অর্ধেক, আট হাজার টাকা। অভিযোগ, তা সত্ত্বেও আরআইও দেশি ইনজেকশন না কিনে দ্বিগুণ দামে বিদেশি সংস্থা থেকেই তা কিনতে থাকে।
ভবানী রায়চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি এ নিয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক ও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে লিখিত অভিযোগ জানান। এরই মধ্যে র্যানিবিজ়ুম্যাব ইনজেকশন কিনতে আরআইও কেন্দ্রের কাছে টাকা চায়। জাতীয় অন্ধত্ব নিবারণ কর্মসূচির তহবিল থেকে ১৫ মার্চ আরআইও-কে কেন্দ্র দু’কোটি টাকা দেয়। কিন্তু ১৬ মার্চ কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক চিঠি দেয় রাজ্যের মুখ্যসচিবকে। তাতে বলা হয়, বিদেশি সংস্থার বদলে দেশি সংস্থা থেকে কম দামে ইনজেকশন কেনাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তার পরেও ২৩ মার্চ আরআইও কেন্দ্রের দেওয়া টাকার অর্ধেক, অর্থাৎ এক কোটি দিয়ে ২৫০টি ‘প্রিফিল্ড র্যানিবিজ়ুম্যাব’ ইনজেকশন কেনে বিদেশি সংস্থা থেকেই।
এ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে জলঘোলা হতে শুরু করায় গত বছরের ১০ মে রাজ্যের তৎকালীন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা একটি নির্দেশ জারি করে আরআইও-কে র্যানিবিজ়ুম্যাব ইনজেকশন কেনা স্থগিত রাখতে বলেন। ফলে হাতে আরও এক কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও আরআইও আর র্যানিবিজ়ুম্যাব কিনতে পারেনি। এ দিকে, প্রি-ফিল্ড র্যানিবিজ়ুম্যাব ইনজেকশন কমতে কমতে আরআইও-তে ৭৫টিতে (ক’দিন আগের হিসাবে) এসে ঠেকেছে। সেখানে মাসে ২৫-৩০টি ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। এটি না পেলে রেটিনার সমস্যা নিয়ে আসা সদ্যোজাতেরা অন্ধ হয়ে যেতে পারে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, ৭৫টি ইনজেকশনে মেরেকেটে ২০ দিন চলতে পারে।
স্বাস্থ্য দফতরের চক্ষু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কল্যাণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘বিষয়টি দেখা হচ্ছে। দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।’’ আরআইও-র অধিকর্তা অসীমকুমার ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রি-ফিল্ড ইনজেকশনে সদ্যোজাতদের রেটিনায় সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু ভায়াল থেকে সিরিঞ্জে ওষুধ টানলে সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। যে হেতু দেশি সংস্থার ইনজেকশন ভায়ালে থাকে, তাই সেটি কিনতে চাইনি। তা ছাড়া, শিশুদের রেটিনার চিকিৎসায় ওই সংস্থার ইনজেকশন কার্যকর, এমন কোনও সরকারি প্রমাণপত্র ওই দেশি সংস্থা প্রথমে আমাদের দেখাতে পারেনি।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘সম্প্রতি ওই দেশি সংস্থা প্রমাণপত্র দেখিয়েছে এবং ওদের ইনজেকশনের দামটাও যে হেতু অনেক কম, তাই ওদের থেকে কেনার সিদ্ধান্ত বিবেচিত হচ্ছে। আশা করছি, সমস্যা মিটবে।’’