গরম হাওয়ায় আজ ভোট

আক্রান্ত কান্তি, শহর দাপাচ্ছে দুষ্কৃতীরা

অশান্তিতে ছেদ তো পড়েইনি, বরং আরও অশান্তির আতঙ্ক বুকে নিয়েই পুরভোটের আগের দিনটা কাটালো কলকাতা। চার দিন আগে আলিপুরে সভা করতে গিয়ে পুলিশের সামনেই নিগৃহীত হয়েছিলেন বিজেপির রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। শুক্রবার রাতে নিজের এলাকায়, পূর্ব যাদবপুর থানা থেকে কার্যত ঢিল ছোড়া দূরত্বে হামলার শিকার হলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। এ বারও অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১২
Share:

কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে সাম্য (বাঁ দিকে)। মুকুন্দপুরে প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অফিসে আক্রান্ত হওয়ার পর। শুক্রবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

অশান্তিতে ছেদ তো পড়েইনি, বরং আরও অশান্তির আতঙ্ক বুকে নিয়েই পুরভোটের আগের দিনটা কাটালো কলকাতা।

Advertisement

চার দিন আগে আলিপুরে সভা করতে গিয়ে পুলিশের সামনেই নিগৃহীত হয়েছিলেন বিজেপির রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। শুক্রবার রাতে নিজের এলাকায়, পূর্ব যাদবপুর থানা থেকে কার্যত ঢিল ছোড়া দূরত্বে হামলার শিকার হলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। এ বারও অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। যাদবপুরের বাসিন্দাদের বড় অংশ অভিযোগ করেছেন, এ দিন রাত থেকেই মোটর সাইকেল নিয়ে এলাকায় নেমে পড়েছে বহিরাগত যুবকেরা। তাদের দাপটে কার্যত গুটিয়ে গিয়েছেন ভোটারদের একাংশ। শুধু যাদবপুর নয়, শহরের নানা অঞ্চলেই বাইরে থেকে প্রচুর দুষ্কৃতী জড়ো হয়ে ডেরা বেঁধেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। শনিবার, ভোটের দিন তারা সক্রিয় হয়ে অশান্তি বাধাতে পারে বলে আতঙ্কে ভুগছেন পুরবাসী।
কী ভাবে মালুম হচ্ছে বহিরাগতদের উপস্থিতি?
স্থানীয় বাসিন্দারা দেখতে পাচ্ছেন, ই এম বাইপাস লাগোয়া বেণুছায়া এলাকায় সদ্য বাঁধা হয়েছে একটি ম্যারাপ। শুক্রবার বিশাল উনুনে মস্ত কড়াই বসিয়ে সেখানে রান্না হয়েছে মুরগির মাংস-ভাত। সেখান থেকেই শালপাতায় মুড়ে দিনভর তা সরবরাহ করা হয়েছে আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে। মাঝে মাঝে চার-পাঁচ জনের এক একটি দল এই ম্যারাপের একপাশে বসে খেয়েও গিয়েছেন। আশপাশের বেশ কয়েকটি নির্মীয়মাণ বাড়ি ও অনুষ্ঠান-বাড়ি ভরে গিয়েছে অচেনা লোকজনে। এলাকার মানুষরা দেখছেন, মোটর সাইকেলে চড়ে এই সব বাড়িতে ঢুকছেন শক্তপোক্ত চেহারার যুবকেরা। এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এদের আগে কখনও দেখিনি। তবে চেহারা, হাবভাব দেখে এদের খুব সুবিধার লোক বলে মনে হচ্ছে না। দিনভর দেদার খাওয়া-দাওয়া চলছে! রাতে বাড়ির বাইরে ছোড়া হচ্ছে মদের বোতল!’’

পুলিশেরও একটি সূত্র বলছে, যাদবপুর এলাকার ১০২, ১০৩, ১০৪, ১০৮, ১০৯ ও ১১০ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন ডেরায় আশ্রয় নিয়েছে বহিরাগতরা। ভাঙড়, বামনঘাটা, কাশীপুর এলাকা থেকে আনা এই দুষ্কৃতীদের রাখা হয়েছে বেণুছায়া এলাকায়। পুলিশের ওই অংশ জানাচ্ছে, ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চসায়র এলাকায় কয়েকটি ভাড়া বাড়িতেও ডেরা বেঁধেছে বহিরাগতরা। একই চিত্র বেহালার ঠাকুরপুকুর ও জোকা এলাকায়। সেখানেও বেশ কয়েকটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে ডেরা গেড়েছে কয়েকশো যুবক। ক্যানিং ও আশপাশ থেকে আসা দুষ্কৃতীদের রাখা হয়েছে সেখানে। এলাকার বেশ কয়েকটি ক্লাবের সদস্যরা তাদের খাতিরযত্নের দায়িত্ব নিয়েছে। রয়েছে দেদার খানাপিনার আয়োজন। দুষ্কৃতীদের আর একটি দলকে রাখা হয়েছে বন্দর এলাকার ১৩৩, ১৩৪, ১৩৫, ১৩৬ ও ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে। মহেশতলা, বজবজ, জয়নগর থেকে আনা হয়েছে এই সব দুষ্কৃতীকে। ৯৯ নম্বর ওয়ার্ডেও বাইরে থেকে প্রচুর লোক আনা হয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

শুক্রবার রাত থেকেই এই সব যুবকেরা নেমে পড়েছে ‘কাজে’।

‘কাজ’টা কী?

মুকুন্দপুরের প্রতিবন্ধী স্কুলের অফিসের ভিতরে ঢুকে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিপিএমের প্রবীণ নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে নিগ্রহের ঘটনাতেই তার জবাব মিলেছে। এলাকায় দুষ্কৃতীদের হামলা রুখতে গত কয়েক দিন ধরেই সিপিএম কর্মীদের নিয়ে রাতপাহারা দিচ্ছিলেন কান্তিবাবু।

এ দিন কী হয়েছিল?

কান্তিবাবু জানিয়েছেন, শুক্রবার সন্ধে সাতটা নাগাদ তিনি মুকুন্দপুরে রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অফিসে গিয়েছিলেন। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হঠাৎই ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের যুব সভাপতি পিনাকী দেব জনা চল্লিশ লোক নিয়ে তাঁর অফিসে আসেন। ওই সময় ঘরের ভিতরে ছিলেন কান্তিবাবু। বাইরে ছিলেন তাঁর গাড়ির চালক সঞ্জয় মণ্ডল। অভিযোগ, প্রথমে ওই দলের মধ্যে থেকে কয়েক জন সঞ্জয়কে মারধর করে। এর পরে তারা ঘরের ভিতরে ঢুকতে গেলে বাধা দেন কান্তিবাবুর দুই দেহরক্ষী উৎপল মাইতি ও গণেশ গিরি। তাঁদেরও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এর পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন কান্তিবাবুর ছেলে সাম্য। তাঁকে মারধর করতে দেখে কান্তিবাবু বেরিয়ে আসেন। তখনই কান্তিবাবুকে ঘাড়ের কাছে ধাক্কা দেয় তৃণমূলের কয়েকজন লোক। এতে কান্তিবাবুর চশমা খুলে পড়ে যায়। বেদম প্রহার করা হয় সাম্যকে। অফিসে থাকা দু’জন প্রতিবন্ধীকেও মারধর করা হয়। অভিযোগ, ওই দলের অনেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। হামলার খবর পেয়ে ওই স্কুলে চলে আসেন এলাকার কয়েকজন সিপিএম কর্মী। এর মধ্যে অমল দাস নামের এক কর্মীকেও মারধর করা হয়। কান্তিবাবু জানান, প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে এই তাণ্ডব চলে। গোটা ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। তাঁর অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা এলাকার আরও কয়েকটি বাড়িতেও ভাঙচুর চালিয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে পূর্ব যাদবপুর থানার দূরত্ব মাত্র ৪০ মিটার। সিপিএম কর্মীরা সেখানে ঘটনাটি জানান। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রথমে থানা থেকে কিছু পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। পরে আরও পুলিশকর্মী গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।

বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

তবে কান্তিবাবুর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এলাকার তৃণমূল প্রার্থী অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ওই প্রতিবন্ধী স্কুলে ভোটকেন্দ্র রয়েছে। ভোটের আগের দিন রাতে কান্তিবাবু সেখানে কী করছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনন্যা। তবে তাঁর দলের লোকেরা যে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল, তা স্বীকার করেছেন তৃণমূল প্রার্থী। তৃণমূলের যে নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই পিনাকী দেবও স্বীকার করছেন, তিনি দলের ছেলেদের নিয়ে ওই স্কুলে গিয়েছিলেন। তবে কান্তিবাবুর গায়ে হাত তোলেননি বলেই তাঁর দাবি। পিনাকীরও প্রশ্ন, ‘‘কান্তিবাবু ভোটকেন্দ্রে সভা করছিলেন কেন?’’

এর উত্তরে কান্তিবাবু জানান, ‘‘গত ১৫ বছর ধরেই আমি ওই প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অফিসে আসি। ভোটকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ আলাদা বাড়িতে।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘কান্তিবাবু আদৌ ভোটকেন্দ্রে যাননি। প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অফিসে বসেছিলেন। একই চত্বরে হলেও দু’টি বাড়ি আলাদা।’’ সুজনবাবুর প্রশ্ন— যদি কান্তিবাবু ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন বলে তৃণমূল মনে করে, তবে তারা সরাসরি পুলিশে বা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ না জানিয়ে নিজেরাই কান্তিবাবুকে মারতে এল কেন?

কী বলছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়? রাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি খড়্গপুরে আছি। তাই ঘটনাটি জানি না। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করা হবে।’’

কিন্তু পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী না আসায় ভোটারদের আস্থা জোগানোর কাজে যে খামতি থেকে গিয়েছে তা বৃহস্পতিবারই জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। তবে বিভিন্ন এলাকার গোলমাল নিয়ে কমিশন নিজেই যখন কলকাতা পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলছে, তখন কমিশন নিযুক্ত পর্যবেক্ষকরা কিন্তু কোনও গোলমালের খবরই দেননি। পর্যবেক্ষকদের এই ভূমিকার পরে শনিবারের ভোট কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে, তা নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী নেতারা। সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি সব দলের নেতাদেরই বক্তব্য, পুলিশ ও প্রশাসনকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছে শাসক দল। এ দিন যেমন ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল-বিজেপি বচসার ঘটনায় পুলিশ বিজেপি এজেন্ট ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করেছে। বিজেপি এতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে। পাশাপাশি সিপিএম নেতাদের অভিযোগ, শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের শাসানো চলছে। বলা হচ্ছে, ‘ভোট দিতে গিয়ে কিছু হলে, তার দায়িত্ব আমরা নেব না।’ বেলেঘাটার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সামনে এসে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ভোট দিতে গেলে বিপদ হবে।’’ পার্ক সার্কাসের কয়েকটি জায়গার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, তাঁরা যাতে ভোট দিতে যেতে না পারেন, তাই তাঁদের সচিত্র পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত ১০টা নাগাদ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শহিদ কলোনিতে চঞ্চল দাস নামের এক সিপিএম কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন তৃণমূলের বিক্ষুদ্ধরাও। তাঁদের অভিযোগ, কাশীপুরে এ দিনও দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে শাসক দলের কর্মীরা।

সন্ত্রাসের মোকাবিলায় সিপিএম কর্মীদের প্রতিরোধে নামতে নির্দেশ দিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। একই সুরে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘মাত্র চার বছরেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলেই তৃণমূলকে এই পথে যেতে হচ্ছে।’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘ মানুষের উপর আর আস্থা রাখতে পারছে না তৃণমূল। তাই এ ভাবে সন্ত্রাস চালিয়ে ভোট করতে হচ্ছে।’’ প্রতিরোধের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরাও। কিন্তু এ দিন রাতে বাইরে থেকে আসা বহু দুষ্কৃতী বিভিন্ন এলাকায় নেমে পড়ায় শেষ পর্যন্ত এই প্রতিরোধ কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তবে বিরোধী-অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পার্থবাবু বলেন, ‘‘আমাদের সন্ত্রাসের প্রয়োজন নেই। বিরোধীরা জনগণের আস্থা হারিয়েছেন। এখন শাসক দলের সন্ত্রাসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করছেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement