ঐতিহাসিক: আলিপুরে জেলা জজ ভবনের একতলার এই এজলাসে রয়েছে সংগ্রহালয়টি। ছবি: সুমন বল্লভ।
কত অখ্যাত লোকের হাত ধরেই বড় বড় ঘটনা ঘটে যায়। যেমনটি ঘটেছিল আলিপুর জাজেস কোর্ট চত্বরে জেলা জজের ভবনের একতলায়। ব্রিটিশ আমলের জাঁদরেল আলমারিটা খুলতে যখন পেশকারও জব্দ, উকিলবাবুরা তখন এক ঝানু চোরের শরণ নিলেন।
দু’দশক আগের কথা। তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা জজ পিয়ারিলাল দত্তই অবস্থা বুঝে অনুমতি দিয়েছিলেন। কোর্টে শুনানির ফাঁকে সেই চোরই তখন মুশকিল আসান। কী-সব কেরামতির জোরে নকল চাবি গড়তে তারও দিন তিনেক লেগেছিল। আলমারির দরজা হাট হল এর পরই। ফের আলো দেখল ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।
আলিপুর বোমা মামলার সেই বিখ্যাত এজলাস কক্ষে ‘আসামি’ অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বোমা-বিশারদ হেমচন্দ্র দাসদের গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় গল্পটা বললেন জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়। এ ঘরে ঢুকলেই একটা ছটফটানি টের পান শান্ত সৌম্য উকিলবাবু জয়ন্ত। বলতে থাকেন, ‘‘আলমারি খুলে কবেকার কাগজগুলো ঘাঁটতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! কখনও কি ভেবেছি, আলিপুর বোমা মামলায় ঋষি অরবিন্দের বেকসুর খালাস হওয়ার রায় বা ক্ষুদিরামের ফাঁসির সাজার কাগজ হাতে নিয়ে দেখব!’’
শুনতে শুনতে বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ইন্দ্রনীল বসু বা আইনজীবী সাফিনা আহমেদরাও তখন বুঁদ। অরবিন্দদের মামলা-খ্যাত, একদা আলিপুর কোর্টের ১৪ নম্বর অতিরিক্ত জেলা জজের সেই এজলাস এখন এক সংগ্রহালয়। শুধু অরবিন্দই নন, লাগোয়া দু’টি ঘরে ক্ষুদিরাম বসু-প্রফুল্ল চাকী, স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশদের স্পর্ধা ও রাজদ্রোহের তাড়া-তাড়া নথি।
অরবিন্দদের মামলার নথি নাকি ফালতু কাগজ বলে ফেলে দিতেই বলেছিলেন ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকের কোনও জজসাহেব। তা চুপিচুপি কাপড়ের পুঁটলিতে করে নাজিরখানায় ফেলে রাখেন জনৈক পেশকার। যা পরে সেই আলমারিতে ঠাঁই পেয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে, ১৯৯৭ সালে আলিপুরের জেলা জজ গোরাচাঁদ দে’র আমলেই ফের সে-সবের খোঁজ পড়ল। ‘আসামি’ অরবিন্দ, আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশদের স্মৃতিধন্য এজলাসকক্ষে মিউজিয়ম গড়তে বিচারক পিয়ারিলাল দত্তও কম দৌড়ঝাঁপ করেননি। আলিপুর বোমা মামলার নথির মধ্যেই সে কালের আরও ২৪টি রাজদ্রোহের মামলার হদিশ ছিল, যার মধ্যে ছিল মজফ্ফরপুর থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদিরামের মামলার নথিও। অরবিন্দদের শুনানির সূত্রে তথ্যপ্রমাণ বাবদ তা-ও তখন আলিপুর কোর্টে পেশ করা হয়।
পাশে আলিপুর পুলিশ কোর্ট থেকে বিনয়-বাদল-দীনেশ ও নেতাজির রাজদ্রোহের মামলার নথিও আনা হয় এই সংগ্রহালয়ে। কাচের শো-কেসে এখনও রয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশের হাতে নিহত কুখ্যাত আইজি (কারা) সিম্পসনের সুরতহাল রিপোর্ট। নেতাজির সই রয়েছে ওকালতনামায়। তাঁর মহানিষ্ক্রমণের পরে দায়ের হওয়া দেশদ্রোহের একটি মামলার নথিও রাখা হয়েছে।
আর একটি শো-কেসে রাসবিহারী বসুদের নামে রাজাবাজার বোমা মামলার নথি অবশ্য আলিপুর জাজেস কোর্টের রেকর্ড বিল্ডিং থেকেই মিলেছিল। ছোটখাটো ফুটবলের মাপের একটি ধাতব গোলকও পাশেই রাখা, যা অনেকে বোমা বলে ভুল করেন। জয়ন্তবাবুই বললেন, ‘‘ওটা বিপ্লবীদের তৈরি মাইন, জানেন! পাঁচটা পাতলেই নাকি ব্রিটিশের সেনা ক্যান্টনমেন্ট ওড়ানো যেত।’’
গাইডের অভাবে এখন ভরসা জয়ন্তবাবুর মতো উৎসাহী ইতিহাসপ্রেমীই। সব নথির উন্নত ঢঙে রক্ষণাবেক্ষণের আশায় হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছেন বার অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক ইন্দ্রনীলবাবু। কিছুটা লোকাভাবেই বার লাইব্রেরির উল্টো দিকে সরকারি আইনজীবীর ঘরের পাশে সংগ্রহালয়ের সদর দরজা সচরাচর খোলা হয় না। কোর্টের প্রাত্যহিক ব্যস্ততা, ঝুটঝামেলা টানাপড়েনে খুব বেশি কেউ টের পান না— এখানেই মূর্ত বাঙালির শৌর্যের অধ্যায়।
ইতিহাসের সুরভিময় এজলাসে আপন মনে কথা বলে আদ্যিকালের নিষ্প্রাণ টাইপরাইটার। আত্মমগ্ন সমকালের সে ঘরে প্রবেশ নিষেধ।