SAMBIA

তথ্য ছাড়াই প্রমাণের চেষ্টা, খুনের মামলায় সাম্বিয়াকে অব্যহতি দিয়ে পুলিশকে তুলোধোনা বিচারকের

প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল সাম্বিয়াকে। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই বিচারকের কথা শুনে এজলাসে হাসি ফোটে সাম্বিয়ার মুখে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:৪৩
Share:

তৌসিফ সোহরাব ওরফে সাম্বিয়া। ডান পাশে দুর্ঘটনায় মৃত বায়ু সেনা কর্মী অভিমন্যু গৌড়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আবেগতাড়িত হয়ে তদন্ত করেছে পুলিশ। উপযুক্ত তথ্য ছাড়াই খুন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তদন্তকারীরা। যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অনুযায়ী তথ্য প্রমাণ নেই। এ ভাবেই বুধবার রেড রোড কাণ্ডে রায় দিতে গিয়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখাকে তুলোধোনা করলেন বিচারক। আমেরিকান সেন্টারে হামলা মামলা থেকে শুরু করে বৌবাজার বিস্ফোরণের সফল তদন্ত করা কলকাতা গোয়্ন্দা পুলিশের এই শাখার কার্যত মুখ পোড়ে এ দিন।

Advertisement

এ দিন সকাল সাড়ে দশটার নাগাদ এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত তৌসিফ সোহরাব ওরফে সাম্বিয়াকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে এনে হাজির করা হয় বিচারভবনে। প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল সাম্বিয়াকে। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই বিচারকের কথা শুনে এজলাসে হাসি ফোটে সাম্বিয়ার মুখে।

নগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচারক মৌমিতা ভট্টাচার্যের এজলাসে রেড রোড কাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলেছে ঠিক এক বছর ১৪ দিন ধরে। ১৭ জানুয়ারি বিচার শেষ হওয়ার পর আজ ছিল রায়দানের দিন।

Advertisement

আরও পড়ুন: তদন্ত নিয়ে তুলোধোনা পুলিশকে, রেড রোড কাণ্ডে খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি সাম্বিয়াকে

২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি সকালে দুর্ঘটনার সময়কার ভিডিয়ো ফুটেজ

২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি সকাল ছ’টা নাগাদ রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের সেনা মহড়া চলাকালীন হঠাৎই নিরাপত্তা বেস্টনী ভেঙে ঢুকে পড়ে একটি সাদা রঙের অডি কিউ-৭ গাড়ি। প্রবল গতিতে সেই গাড়ি সেনা কর্মীদের দিকে এগিয়ে আসে। গাড়ির চাকায় পিষে যায় বায়ু সেনা আধিকারিক অভিমন্যু গৌড়ের দেহ। বায়ু সেনা কর্মীকে পিষে দিয়ে পালাতে গিয়ে অন্য এক সেনা কর্মীকে ধাক্কা মারে গাড়িটি। তারপর কিছুদুর গিয়ে লক হয়ে যাওয়া গাড়ি ছেড়ে পালায় চালক। পরবর্তীতে জানা যায় ওই গাড়ি প্রাক্তন রাষ্ট্রীয় জনতা দল বিধায়ক বড়বাজারের ফল ব্যবসায়ী মহম্মদ সোহরাবের কোম্পানির নামে কেনা এবং চালকের আসনে ছিলেন সোহরাবের ছোট ছেলে সাম্বিয়া।

একের পর এক নিরাপত্তা বেস্টনী ভেঙে সেনা কর্মীকে ধাক্কা মারার অভিযোগে খুনের মামলা রুজু করে কলকাতা পুলিশ। সাম্বিয়াকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য গ্রেফতার করা হয় তাঁর দুই বন্ধু নূর আলম ওরফে জনি এবং শাহ্‌নওয়াজ খান ওরফে শানুকে। অপরাধের প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে অভি‌যুক্তের তালিকায় আনা হয় সাম্বিয়ার বাবা সোহরাবের নামও।

সাম্বিয়াকে গ্রেফতারের ৫৮ দিনের মাথায় সাম্বিয়া সহ চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন), ৩০৭ (খুনের চেষ্টা) ধারায় অভিযুক্ত করা হয় সাম্বিয়াকে। ২০১ (তথ্য প্রমাণ লোপাট) ধারায় অভিযুক্ত করা হয় সোহরাবকে এবং সাম্বিয়ার দুই বন্ধু জনি ও শানুকে ২১২(অপরাধীকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করা) ধারায় অভিযুক্ত করা হয়।

২০১৭ সালের মে মাসে চার্জ গঠনের সময় ম্যাজিস্ট্রেট মণিশঙ্কর ত্রিপাঠি জনি,সোহরাব এবং শানুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪(পার্ট ২) যুক্ত করেন। যার অর্থ অনিচ্ছাকৃত খুন কিন্তু এটা অভিযুক্ত জানতেন, যে ওই ভাবে গাড়ি চালিয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং প্রাণহানি হতে পারে।

আরও পড়ুন: রাজপথে ‘আটক’ শিক্ষামন্ত্রী, কনভয় ঘিরে বিজেপির বিক্ষোভ, কালো পতাকা

বুধবার বিচারভবনে সাম্বিয়া। —নিজস্ব চিত্র।

সে সময় কলকাতা পুলিশ নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গেলে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে অব্যহতি পাওয়া তিনজনের বিরুদ্ধেও চার্জ গঠন করার নির্দেশ দেন। পরের বছর ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব যেখানে সরকারি আইনজীবী তমাল মুখোপাধ্যায় ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫১ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করেন। গোটা বিচার প্রক্রিয়াতে তদন্তকারীরা আদালতকে জানান, সাম্বিয়া যে ভাবে একের পর এক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে কুচকাওয়াজের জায়গায় পৌঁছয় এবং ধাক্কা মারে গৌড়কে তাতে স্পষ্ট তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুনের।

এ দিন বিচারক রায় দানের সময় পরিষ্কার বলেন, কলকাতা পুলিশের পেশ করা কোনও তথ্য বা সাক্ষ্য প্রমাণ করতে পারেনি সাম্বিয়ার বিরুদ্ধে তোলা খুনের মোটিভ কি। এই প্রসঙ্গে বিচারক অটোপ্সি সার্জেনের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ময়না তদন্তের রিপোর্টে প্রথমে ওই চিকিৎসক জানাননি যে ওই বায়ু সেনা কর্মীর মৃত্যু দুর্ঘটনা না খুন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাঁর সাক্ষ্যতে যে ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে ওটি খুন তাতে স্পষ্ট যে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন।

ঠিক একই ভাবে কলকাতা পুলিশের তদন্তকেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ইঙ্গিত করেছেন বিচারক। তিনি বলেন, যে ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার কথা বলা হচ্ছে সেই ট্রাফিকের চিহ্ন পুলিশের গেজেটেই থাকে। সাধারণ মানুষ জানতে পারেন না। তিনি প্রথমেই সাম্বিয়ার বিরুদ্ধে তোলা খুন এবং খুনের চেষ্টার অভিযোগ খারিজ করে দেন। বাকি তিনজনকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। তিনি মন্তব্য করেন, পুলিশ দুর্ঘটনাকে খুন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। বিচারক সাম্বিয়াকে গাফিলতির অভিযোগে অনিচ্ছাকৃত খুনে এবং রাস্তায় পুলিশের লাগানো রেলিং ভেঙে নষ্ট করার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২৭ ধারায় দোষী স্যবস্ত করেন। যার সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছরের কারাবাস। বিচারক ১ লাখ টাকার জরিমানা করেন সাম্বিয়াকে।

আরও পড়ুন: সল্টলেকের এসডিএফ বিল্ডিংয়ে আগুন

দুর্ঘটনার সময় এই গাড়িটিই চালাচ্ছিল সাম্বিয়া। —ফাইল চিত্র।

যেহেতু গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে দু’বছরের বেশি সময় ধরে সাম্বিয়া জেল বন্দি তাই জরিমানা জমা দিলেই মুক্তি পাবে সাম্বিয়া। এ দিন বিচারক তাঁর রায়ের একটি কপি কলকাতা পুলিশের কমিশনারকেও পাঠানোর নির্দেশ দেন। সাম্বিয়ার আইনজীবী অশোক বক্সি বলেন,“ খুন ধরে নিয়েই তদন্ত এগিয়েছে পুলিশ। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার সময় তাঁরা তার প্রমাণ দিতে পারেননি। অটোপ্সি সার্জেনের পরে পাঠানো মতামত বিচারক খোলা মনে নিতে পারেননি।” আদালতের রায় নিয়ে এ দিন মুখ খোলেননি সেনা কর্তৃপক্ষ। এ দিন তাঁদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন আদলতে। রায় নিয়ে মন্তব্য করেননি সরকারি আইনজীবী তমাল মুখোপাধ্যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement