অবৈধ বসতি, খাটাল এবং জঞ্জালের জেরে আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ে বহু বার সরব হয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। তবু ছবিটা বদলায়নি। অবশেষে মঙ্গলবার কলকাতার জাতীয় পরিবেশ আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, দু’সপ্তাহের মধ্যে আদিগঙ্গার পাড়ে অবৈধ বসতি ভেঙে ফেলতে হবে কলকাতা পুরসভাকে।
আদালতের নির্দেশ, এ কাজে সাহায্য করবে কলকাতা পুলিশ। আদিগঙ্গার পাড়ে কলকারখানা ও হোটেল দূষণ ঘটাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। পুরসভাকেও ব্যবস্থা গ্রহণের রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে হবে। যদিও কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘নির্দেশ দিলেই তো সব সময়ে পালন করা যায় না। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই ব্যবস্থা নিতে হয়।’’ তিনি জানান, আদিগঙ্গার দূষণ রোধে ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ওঁদের সঙ্কেত পেয়ে ডিপিআর তৈরি করা হচ্ছে। আদিগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে পুরসভাও তৎপর।
কালীঘাট মন্দির এলাকার কিছু হোটেল দূষণ ঘটাচ্ছে, এ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেন এক আইনজীবী। আদালত দূষণের প্রেক্ষিতটি আরও বড় করে দেখার জন্য পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তকে আদালতবান্ধব হিসেবে নিয়োগ করে। গত ১১ ও ১৩ সেপ্টেম্বর নৌকো নিয়ে হেস্টিংস থেকে আলিপুর পর্যন্ত আদিগঙ্গা পরিদর্শনের পরে এ দিন সুভাষবাবু ৬১টি ছবি-সহ রিপোর্ট আদালতে দেন। সুভাষবাবু জানান, আদিগঙ্গার উপরে বাঁশের কাঠামো করে ঘর হয়েছে, হয়েছে শৌচাগার। যা থেকে সরাসরি মলমূত্র আদিগঙ্গায় পড়ছে। আশপাশের খাটাল থেকেও জলে মিশছে গরু-মহিষের মলমূত্র। এলাকার বহু বাড়ি এবং একটি বড় হোটেলের নালাও সরাসরি আদিগঙ্গায় এসে পড়ছে। এ সবের জেরে আদিগঙ্গার দূষিত জল জোয়ার-ভাটায় মিশছে মূল গঙ্গাতেও।
নদী ও জল বিশেষজ্ঞেরা বারবারই গঙ্গা-দূষণের মাত্রা নিয়ে সরব হয়েছেন। বছর কয়েক আগে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষায় কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় দূষণের মারাত্মক ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদ সূত্রের খবর, গঙ্গার দূষণ মাপা হয়েছিল জলে ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতির ভিত্তিতে। সমীক্ষায় উঠে আসে, দক্ষিণেশ্বর থেকে গার্ডেনরিচ—জলে ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা কোথাও স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ গুণ বেশি, কোথাও সাত গুণ! রাজ্যের এক নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই ব্যাক্টেরিয়ার উৎস মূলত মানুষ ও পশুপাখির মল। টাইফয়েড, জন্ডিসের জীবাণু জলে রয়েছে কি না, তা এর উপস্থিতি দেখেই বোঝা যায়। গঙ্গা ও সংযুক্ত থাকা খাল-নালাগুলির পাশে খাটাল, বস্তি থাকাতেই এই দূষণ বাড়ছে বলে জানান তিনি।
সুভাষবাবুর রিপোর্ট এবং আদালতের নির্দেশের কথা শুনে রাজ্যের এক পরিবেশকর্মী বলেন, ‘‘আমরা এত দিন ধরে বললেও পুর-প্রশাসন আমল দেয়নি। আদালতের নির্দেশে কতটা নড়েচড়ে বসে, সেটাই দেখার।’’ মেয়র অবশ্য বলেন, ‘‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছাড়া আমরা কিছু ভাঙতে পারি না।’’
শুধু বসতি নয়, প্রশ্ন উঠেছে দূষণ ছড়ানোয় আদিগঙ্গা সংলগ্ন কলকারখানা ও হোটেলের ভূমিকা নিয়েও। এ দিন পর্ষদের আইনজীবী অর্পিতা চৌধুরীকে ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, ওই কারখানাগুলি দূষণ-বিধি মানছে কি না, দেখতে হবে। যে হোটেলটির নালা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।
মামলা শুরু হয়েছিল কালীঘাট এলাকার হোটেল ও দোকানের দূষণ নিয়ে। এ দিন আদালত জানিয়েছে, কালীঘাট মন্দির কর্তৃপক্ষকে ওই এলাকার অবৈধ দোকান ও পরিবেশ নিয়ে হলফনামা জমা দিতে হবে। এই মামলায় বন্দরকেও যুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ আদালত।