হৃষীকেশ এবং রিয়া।
‘আমাদের সময় শেষ। আমরা চাই না, আমাদের মৃত্যু নিয়ে কোনও আলোচনা হোক।’— মঙ্গলবার সকালে বাঁশদ্রোণী থানায় এমন একটি ইমেল আসার পরে আত্মহত্যা রুখতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পুলিশ। ঠিকানা খুঁজে পেতেও সমস্যা হয়নি। কিন্তু দেখা যায়, ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। সেটি ভেঙে ভিতরে ঢুকে পুলিশ দেখে, শোয়ার ঘর প্রবল ঠান্ডা। এসি চলছে। বিছানায় কম্বলের নীচে পাশাপাশি দু’টি মৃতদেহ!
গড়িয়ার ব্রহ্মপুরের এই ঘটনায় একাধিক রহস্য তৈরি হয়েছে। এক দিন পরে, বুধবারও যার উত্তর মেলেনি। লালবাজারের কর্তারা জানান, ওই যুগল ইমেলে লিখেছিলেন, তাঁদের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা তাঁরা চান না। তাই পুলিশ খুব বেশি কিছু বলতে চায়নি। এমনকি, কী ভাবে তাঁদের মৃত্যু হল, তা-ও বলেনি পুলিশ।
মৃতদের নাম হৃষীকেশ পাল ও রিয়া সরকার। দু’জনেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। পুলিশের ধারণা, তাঁরা আত্মহত্যা করেছেন। তাঁদের মোবাইল থেকে নম্বর নিয়ে আত্মীয়-বন্ধুদের খবর দেয় পুলিশ। হৃষীকেশের বাড়ি ছিল আরামবাগে। তাঁর বাবা-মা বহু দিন আগেই মারা গিয়েছেন। এক দিদিও মারা যান ক্যানসারে। রিয়া থাকতেন কেষ্টপুরে। বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁর মা রিয়ার বোনকে নিয়ে সেখানেই থাকেন। বোন বাবার চাকরি পেয়েছেন।
২০১৯ সালে রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় হৃষীকেশের। হৃষীকেশ আগে একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন। কিন্তু চাকরি পাকা হওয়ার আগেই হাইওয়েতে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। হাতে ও চোখে গুরুতর চোট লাগে। ফলে চাকরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চিকিৎসায় খরচ হয় মোটা টাকা। এর পরে রক্তের ক্যানসার ধরা পড়ে হৃষীকেশের। রিয়া একটি পার্লারে কাজ করতেন। পরে হৃষীকেশের সঙ্গে ব্রহ্মপুরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। রেজিস্ট্রি করে বিয়েও সারেন তাঁরা।
এরই মধ্যে লকডাউনে শুরু হয় প্রবল আর্থিক অনটন। ক্যানসারের চিকিৎসা চালাতে নানা জায়গা থেকে হৃষীকেশ ও রিয়া টাকা ধার করেন বলে পুলিশ জেনেছে। সব মিলিয়ে তাঁদের প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার দেনা রয়েছে। সেই কারণেই কি আত্মহত্যা? উত্তর মেলেনি।
পুলিশকে পাঠানো ইমেলে একটি উইল করে রেখে যাওয়ার কথাও লেখা হয়েছে। তাতে জানানো হয়েছে, তাপস দাস নামে এক ব্যক্তি এলে তাঁর হাতেই যেন দেহ দু’টি দেওয়া হয়। রিয়ার পরিবার যাতে দেহ না পায়, উইলে সে কথাও রয়েছে। থানায় হাজির সেই তাপস বললেন, ‘‘গাড়ি সার্ভিসিং সংস্থায় কাজ করতাম। সেখানেই গাড়ির কাজ করাতেযাওয়া হৃষীকেশের সঙ্গে পরিচয়। ক্যানসারের কথা তখনই শুনি। হৃষীকেশ বলেছিল, আমাদের মৃত্যুর পরে সৎকারের দায়িত্ব নিও। রিয়ার পরিবার যে ভাবে অপমান করেছে, তার পরে ওদের যেন দেহ না দেওয়া হয়।’’ পুলিশের দাবি, ক্যানসারে আক্রান্ত হৃষীকেশের সঙ্গে বিয়ে মানতে পারেনি রিয়ার পরিবার। তাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রিয়া। গত দু’বছরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কিন্তু মৃত্যুর আগে সকলকে একটি ভয়েস নোট পাঠিয়ে তাঁকে এবং হৃষীকেশকে কী ভাবে অপদস্থ করা হয়েছে, তা বলে গিয়েছেন।
থানায় হাজির রিয়ার মা মৌসুমী সরকার কিছু বলতে চাননি। রিয়ার পিসি লিপিকা সিংহ বলেন, ‘‘ছেলেটা বলেছিল, বিয়ে করবে না। এমনিই একসঙ্গে থাকবে। তাই আমরা আপত্তি করি। কেন বিয়ে করবে না, জানতে চাওয়ায় রিয়া বলেছিল, হৃষীকেশ ক্যানসারে ভুগছে। ২০২০-র জানুয়ারিতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় রিয়া। আর যোগাযোগ রাখেনি। ২১ দিন বয়স থেকে আমার কোলেপিঠে মানুষ। কী রকম লাগছে, তা আমিই জানি।’’
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় যদিও বললেন, ‘‘দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরিণতি জেনেও যখন স্বেচ্ছায় একসঙ্গে থাকতে চাইছেন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোটা সামাজিক অশিক্ষা। এই প্রবণতা বন্ধ হোক। ক্যানসার রোগীকে দূরে না ঠেলে বেশি করে পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই ব্যাধির সঙ্গে লড়েও বিয়ে করার বা এমনিই একসঙ্গে থাকার প্রচুর উদাহরণ দেখেছি। এটাও তেমনই। কিন্তু শেষে লড়াই ছেড়ে আত্মহত্যাটা মানা যায় না।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।