ভবানীপুরের ফুটপাতে পড়াশোনায় ব্যস্ত সন্ধ্যা অধিকারী। নিজস্ব চিত্র
লকডাউনের ভরা দুপুরে ফাঁকা রাস্তা। তবু ভিড় কমে না ফুটপাতে। ভবানীপুরে বিজলি সিনেমা হলের সামনে তেমনই এক ফুটপাতে পরপর শুয়ে কয়েক জন। পাশে আরও তিন চার জন মুখে গামছা জড়িয়ে বসে। কিছুটা তফাতে ফুটপাতের উপরে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা লিখে চলেছেন এক বৃদ্ধা। মোটা কাচের চশমা মুছে নিয়ে মাটিতে রাখা ছোটদের রামায়ণ বই দেখে দেখে টুকে রাখছেন কোলের মোটা রুলটানা খাতায়!
এই বয়সে পড়াশোনা? উত্তর নেই বৃদ্ধার। টিভিতে আবার রামায়ণ দেখাচ্ছে, জানেন? ঝাঁঝিয়ে উঠে বৃদ্ধা বললেন, “টিভি কোথায় এই ফুটপাতে! নাতনির জন্য লিখে রাখছি।” নাতনি কোথায়? খাতার দিকে চোখ রেখেই বৃদ্ধা বলেন, “যে বাড়িতে কাজ করি, সেখানে ওকে থাকতে দিয়েছে। করোনা হচ্ছে না! আমি মরলে ক্ষতি নেই, কিন্তু নাতনিটাকে কি এর মধ্যে এখানে রাখা যায়!”
করোনা-আতঙ্কের এই পরিস্থিতিতে সামাজিক ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। তবে শহরের ফুটপাতবাসীদের কী হবে, এ নিয়ে উত্তর নেই কারও কাছে। লকডাউনের এক সপ্তাহ পেরোলেও এখনও তাঁদের জন্য কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা করা যায়নি। যেমন কোনও ব্যবস্থা হয়নি ভবানীপুরের এই ফুটপাতবাসিনীর জন্য।
সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধার নাম সন্ধ্যা অধিকারী। আদতে মেদিনীপুরের বাসিন্দা। স্বামীর মৃত্যুর পরে মেয়ে, তাঁর কোলের সন্তান এবং জামাইকে নিয়ে কলকাতায় আসেন। কিছু দিন বাদেই সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে অন্যত্র চলে যান তাঁর মেয়ে। জামাই আর যোগাযোগ রাখেন না। সেই থেকে নাতনি পূজাই দিদিমার জগৎ। লোকের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে নাতনিকে ভবানীপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। বিকেলে নাতনি স্কুল থেকে ফিরলে ফুটপাতের সংসারে দিন কাটে তাঁদের। সেখানেই চলে দিদিমা-নাতনির পড়াশোনা। সন্ধ্যায় দিদিমা যখন রাতের রান্না করেন, পাশে বসে পড়ে পূজা। রান্না শেষ হলে দিদিমাকে হাতে ধরে লেখা শেখায় সে। কিন্তু এত কিছুর পরেও নাতনির জন্য মাথার উপরে ছাউনির ব্যবস্থা করতে পারেননি সন্ধ্যাদেবী। তাঁদের রাত কাটছিল ফুটপাতেই।
কিন্তু দিদিমা-নাতনির দিনযাপনের সেই চেনা ছবি বদলে দিল করোনাভাইরাস। বৃদ্ধা বলছেন, “গত সপ্তাহের শুরু থেকে সব কেমন বদলে গেল। পূজাদের স্কুল আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। ও স্কুলে থাকলে একটু শান্তিতে থাকতাম। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় বাঁশদ্রোণীতে যে বাড়িতে কাজে যাই, সেখানে পূজাকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এক দিন ফিরে শুনি, পুলিশ এসে মারধর করে গিয়েছে। ফুটপাতে থাকতে দেবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।”
বৃদ্ধা জানান, নাতনির স্কুল থেকে ওকে একটা হোমে রাখার জন্য বলেছিল। নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীর পক্ষে ফুটপাতে থেকে কী ভাবে পড়াশোনা চালানো সম্ভব, তা নিয়েই চিন্তা ছিল তার দিদিমণিদের। “আমার ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এই করোনার জন্য তো ছাড়তেই হল!”— বলতে বলতে চোখ জলে ভরে আসে তাঁর।
মন কেমন করে নাতনির জন্য? বৃদ্ধা বলেন, “নাতনিটার উপরে লাঠির ঘা পড়লে বাঁচব না। যে বাড়িতে কাজ করি, ওঁরা ওকে রেখে দিলেন। বড় ভাল মানুষ ওঁরা। এখন কাজে গেলে দেখা হয় পূজার সঙ্গে। ফিরে ওর জন্যই রামায়ণ লেখা চালিয়ে যাই। আসলে সব সময় মনে পড়ে ওকে। এখন একটু তাড়াতাড়িই কাজে চলে যাই ওকে দেখার জন্য।”
লকডাউন উঠলে আবার কি দিদিমা-নাতনি ফিরবে ফুটপাতের সংসারে? শুরু হবে আগের মতোই ভালবাসার বিদ্যাচর্চা? অনেক কিছুর মতোই এর উত্তরও আপাতত অজানা।