প্রতীকী ছবি।
বাইশ বছর আগে, সেই ১৯৯৮ সালে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতই প্রথম পথ দেখিয়েছিল। যখন কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক সেই বছরের জুলাইয়ে ওই বর্জ্যের বিপদ বুঝে ‘বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং) রুলস’ জারি করেছিল। কিন্তু এশিয়ার মধ্যে অগ্রণী হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশের বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরবর্তীকালে ‘দিগ্ভ্রান্ত’ হয়ে পড়ল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, কোভিড-বর্জ্য তো গত আট মাসের ব্যাপার। এই সংক্রমণ না হলে তো বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ, নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া, প্রক্রিয়াকরণ-সহ সমস্ত ধাপে কতটা ‘ফাঁক’ রয়েছে, তা বোঝা যেত না।
এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটি রয়েছে, কোভিড সংক্রমণ সেগুলোকে বেআব্রু করে দিল। কারণ, এত দিন না হয় যে কোনও ভাবে চলছিল, কোভিড-বর্জ্যই প্রকৃত চিত্র সামনে এনে দিল।’’ যদিও রাজ্য সরকারের তরফে এই তথ্য মানতে চাওয়া হয়নি। রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের বক্তব্য, ‘‘পরিবেশ দফতরের যেটুকু দায়িত্ব, তা আমরা করছি। বাকি বিষয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতাল চত্বরের যে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য, তার দায়িত্ব সরকারই নেয়। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও যথেষ্ট ভাল কাজ করে। কিন্তু বাড়ির বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের দায়িত্ব সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে। কিন্তু সেখানে সচেতনতার যথেষ্ট খামতি রয়েছে।’’
কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ১৯৯৮ সালের ওই আইনের উপরে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ‘বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস, ২০১৬’ জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, ক্লিনিক, পরীক্ষাগার, ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রাণী চিকিৎসাকেন্দ্র-সহ যে সমস্ত জায়গায় বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার সবই এই আইনের আওতায় আসবে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ওই আইনে আরও কিছু সংশোধন হয়। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য বক্তব্য, আইন হলেও অন্য সমস্ত কিছুর মতো তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। রাজ্যের কোভিড-বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও তা নষ্টের নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরির জন্য রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নব দত্ত বলেন, ‘‘বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের আইন ও তার বাস্তবায়নে যে কী অপরিসীম দূরত্ব রয়েছে, কোভিড-বর্জ্য তা এক ঝটকায় সামনে এনে দিয়েছে। কোভিড-বর্জ্যের কারণে বোঝা যাচ্ছে যে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষ, সব পক্ষেরই চরম উদাসীনতা রয়েছে।’’ এক সময়ে এ বিষয়ে আদালতবান্ধব হিসেবে কাজ করা পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, “বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের বিপদ আমরা এত দিনেও যে বুঝে উঠতে পারলাম না, এটাই দুর্ভাগ্যের!”
ইন্দিরা গাঁধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব হেলথ সায়েন্সেস’-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর তথা ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব হসপিটাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর প্রেসিডেন্ট অশোক আগরওয়ালের কথায়, ‘‘কোভিড বর্জ্য তো গত মার্চ থেকে এসেছে। কিন্তু তার আগে থেকেই সরকারি-বেসরকারি সমস্ত স্তরের বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা ভাল নয়। বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য কী ভাবে সামলাতে হয়, তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে।’’ কোভিড সংক্রমণ শুরুর আগে থেকেই বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পশ্চিমবঙ্গে ছ’টি ‘কমন বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট ফেসিলিটিজ়’ (সিবিডব্লিউটিএফ) কাজ করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অশোকবাবুর বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা মোটেই পর্যাপ্ত নয়!’’ দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর (এমস) হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দফতরের বিভাগীয় প্রধান সিদ্ধার্থ শতপথী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্য রাজ্যগুলির জনসংখ্যা ও তার পরিধির নিরিখে পর্যাপ্ত সিবিডব্লিউটিএফ রয়েছে কি না, তা সমীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।’’ কলকাতা, দমদম, নিউ টাউন এবং আরও কিছু এলাকায় কোভিড বর্জ্য-সহ বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও নষ্টের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সিবিডব্লিউটিএফ-এর এক কর্তার অবশ্য দাবি, ‘‘অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ ও তার প্রক্রিয়াকরণের অবস্থা অনেক ভাল।’’