অনিশ্চিত: শ্রোতাদের ভিড়ে ঠাসা ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন। এমন ছবি ফের কবে দেখা যাবে, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে সংশয়। ফাইল চিত্র
রবিশঙ্করের শতবর্ষ পূর্তির দিনটির জন্য কত অপেক্ষা ছিল এ বছর!
লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে বিশ্বমোহন ভট্ট, শুভেন্দ্র রাও থেকে অনুষ্কা শঙ্কর, নোরা জোন্সদের অনেকেরই জড়ো হওয়ার কথা ছিল গত ৭ এপ্রিল। আচমকাই সব ভেস্তে গেল। “১০০ পার করার জন্মদিন তো এক বারই আসে। বাজাতে যেতে না-পারার ক্ষত এখনও বিঁধছে।”— বলছিলেন রবিশঙ্করের স্নেহধন্য শিষ্য, কসবার সরোদ-শিল্পী পার্থসারথি।
তবলাশিল্পী শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করতে পারছেন না, টানা তিন মাস শেষ কবে কলকাতায় থেকেছেন। মধ্য মার্চে দিল্লিতে আমজাদ আলি খানের সঙ্গে অনুষ্ঠান সেরে ফিরেই গৃহবন্দি। লাস ভেগাসে বঙ্গ সম্মেলন থেকে জুলাই-অগস্টে আমেরিকা সফর পর্যন্ত ঠাসা অনুষ্ঠানসূচি তাঁর। দেশেও মৃদঙ্গমের তারকা কাড়াইকুরি মণি বা হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, শিবকুমার শর্মাদের সঙ্গে অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে ব্যস্ত তবলাশিল্পী শুভঙ্করবাবুর। শিবকুমারের সঙ্গে এখন হোয়াটসঅ্যাপে রসিকতা চলছে। তিনি বলছেন, ‘কোভিড-পরিস্থিতিতে হাজার লোকের জায়গায় না-হয় ৩০০ জনকে বসিয়ে গানবাজনা হল, তা মাস্কের কী হবে?’
কেন? শিল্পীরাও মাস্ক পরবেন। বলতেই শিবকুমারের ঠাট্টা, ‘অ্যাঁ, মাস্ক পরে গাইবেও বুঝি!’ কবে যে সব স্বাভাবিক হবে, ধন্দে অনেকেই। তবে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার মতো ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। গুরুপূর্ণিমায় শহরের সহ-শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবেন অজয় চক্রবর্তী। তখনই অনলাইন সম্প্রচার চলবে। রাশিদ খানের অ্যাকাডেমি এই বিচ্ছিন্নতার দিনকালেও সুরের ডানায় বিশ্বভ্রমণে শামিল। ‘সেতু বন্দনম’-এর আহ্বানে প্রতিভাদের মেলে ধরতে ডিজিটাল আঙ্গিকে তাঁরা ঘুরছেন ব্রিটেন-আমেরিকা-কানাডা-দুবাই-বাংলাদেশ।
তবু নেটমাধ্যমে শ্রোতা ও সঙ্গীতের সেতুবন্ধনে কিছু আক্ষেপও মিশে রয়েছে। রাশিদ বলছেন, ‘‘আলাদা শহরে থাকা শিল্পীদের মধ্যে নেটমাধ্যমে সরাসরি যুগলবন্দি এখন কঠিন।’’ সাধারণত দু’টি আলাদা জায়গায় থেকে সেতার-সরোদ ও তবলার সংলাপে কিছু ছন্দপতন ঘটে। প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সেই মুশকিল আসানের চেষ্টা চলছে। তবু প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চের বিকল্প দূর অস্ত্! তাহলে দেশের ঐতিহ্যশালী সব শীতকালীন সঙ্গীত-সম্মেলন হবে তো? ডোভার লেন সম্মেলনের কর্মকর্তা বাপ্পা সেন হাসছেন, ‘‘হবে না, এটা ভাবছিই না! তবে অন্য ধাঁচে কী ভাবে হবে, দরকারে সেটা ভাবব।’’
দেওয়ালে পিঠ-ঠেকা দশায় শিল্পীরা অনেকেই বাড়িতে বা নিজস্ব স্টুডিয়োয় উন্নত মানের রেকর্ডিংয়ে দড় হয়ে উঠছেন। দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে চলছে অনলাইন ক্লাস। ‘‘একটু কম পরিচিত অথচ গুণী শিল্পী, যাঁরা আমার সঙ্গে স্টুডিয়োয় বা মঞ্চে গেয়েছেন, এই ক’মাসে তাঁদের রোজগার শূন্যে ঠেকেছে। তাঁদের কথা ভাবলে কী করে ভাল থাকব!’’— বলছেন কৌশিকী চক্রবর্তী। স্টুডিয়ো, জলসা, পানশালার অনামী গাইয়ে-বাজিয়ে থেকে গ্রামের আখড়ায় লোকগানের শিল্পীরাও এখন কোভিড-শহিদের তালিকায়। নানা স্তরে চেষ্টা চলছে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর। লোপামুদ্রা মিত্র সদ্য বীরভূমে ঘুরে এসেছেন। ক্যালকাটা সিনে মিউজ়িশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা কণ্ঠশিল্পীদের সংগঠনের মাধ্যমে সাধ্যমতো দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছেন সৈকত মিত্র বা জোজো। বলিউড-তারকাদের ভার্চুয়াল শোয়ের ধাঁচে বাংলার বিনোদন-জগতকে নিয়ে একটি ডিজিটাল শোয়ের শরিক রূপম ইসলাম বলছিলেন, ‘‘এই শোয়ে টিকিট থাকছে। জুনের শেষে এই শোয়ের লাভের বেশির ভাগটাই দুঃস্থ শিল্পীরা পাবেন। ব্যাকস্টেজের কর্মী থেকে শিল্পীদের গাড়ির চালক— সবার কথাই ভাবছি।’’
তবে প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী প্রমিতা মল্লিক থেকে কৌশিকী-লোপামুদ্রারা অনেকেই মনে করেন, মঞ্চ থেকে দূরে থাকার দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিনা সাম্মানিকে গান পরিবেশনের ধারায় সীমা টানা উচিত। কারণ তাতেও সহশিল্পীরা বঞ্চিত হন। শ্রোতারা অনায়াসে সব পেতে শুরু করলে আখেরে তা এই সঙ্গীত জগতের জন্যেও খারাপ। রূপম বলছিলেন, ‘‘তা ছাড়া ডিজিটাল আঙ্গিকে আলাদা আলাদা বসে ব্যান্ডের অনুষ্ঠান করাও কঠিন।’’ সেতার-শিল্পী পার্থ বসুর অভিজ্ঞতা, ‘‘বিদেশের অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি তো হয়েইছে। কিন্তু তবলা-মেশিনের সঙ্গে বসলেও রেওয়াজে পাশে সহ-শিল্পীর অভাবটাই বেশি কষ্ট দেয়।’’ ইটালি, ব্রিটেনে অনুষ্ঠান সেরে এই বর্ষায় জার্মানির ওবেরামেরগাওয়ে কয়েকশো বছরের ঐতিহ্যশালী ‘প্যাশন প্লে’ দেখার দুর্লভ টিকিট কেটেছিলেন প্রমিতাদেবীও। কোভিড-আগ্রাসনে সব ভণ্ডুল।
একা একা ঘরে বসে গানবাজনার ক্লান্তি ও হতাশা তাই এ বার গ্রাস করতে শুরু করেছে অনেক শিল্পীকেই।