গোপালবাবুর বেড হেড টিিকটে মৃত্যুর তারিখ লেখা ২৮ এপ্রিল।
গড়িয়া স্টেশন এলাকার বাসিন্দা, কোভিড আক্রান্ত ‘নিখোঁজ’ অশীতিপর বৃদ্ধ গোপালচন্দ্র কুণ্ডুর খোঁজ মিলল হাওড়ার বালিটিকুরি ইএসআই হাসপাতাল থেকেই। তবে মৃত অবস্থায়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার সকালে গোপালবাবুর মৃত্যু হয়। তার পরেই তাঁর দেহ রাখা হয় হাসপাতালেরই একটি ঘরে অন্য মৃতদেহের সঙ্গে। পরে ঘটনাটি নিয়ে শোরগোল হতে বৃহস্পতিবার বেশি রাতে তাঁর দেহটি হাসপাতালের অস্থায়ী মর্গে চিহ্নিত করা হয়। খবর দেওয়া হয় গোপালবাবুর পরিবারকে। কোভিডে মৃত্যুর প্রায় দু’দিন পরেও পরিবারকে খবর না দেওয়ার ঘটনা হাওড়ার অন্যতম গুরুত্বর্পূণ এই কোভিড হাসপাতালের চূড়ান্ত অব্যবস্থাকেই বেআব্রু করে দিয়েছে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে গড়িয়ার নবগ্রাম এলাকার বাসিন্দা গোপালবাবুকে তাঁর ছেলে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে সেখান থেকে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় যাদবপুরের কে এস রায় হাসপাতালে। গোপালবাবুর ছেলে রাতেই ওই হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। মঙ্গলবার রাত দুটো নাগাদ কে এস রায় হাসপাতাল থেকে তাঁদের জানানো হয়, গোপালবাবুকে হাওড়ার বালিটিকুরি ইএসআই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বুধবার সকালে বালিটিকুরি ইএসআই হাসপাতালে যান রোগীর আত্মীয়েরা।
পরিবারের দাবি, ওই দিন হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, রোগী এইচডিইউ-তে ৪ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন। নিয়ম না থাকায় কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। বিকেলে ফোন করে খোঁজ নিতে বলা হয়। পরিবারের অভিযোগ, বিকেলে বার বার ফোন করা হলেও হাসপাতালের কেউ ফোন ধরেননি। এর পরে বৃহস্পতিবার সকালে ফের ফোন করা হলে হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, ওই নামে কোনও রোগী সেখানে ভর্তি নেই। এমনকি, বৃহস্পতিবার রাতেও হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিসে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কিছু জানাতে পারেননি। তবে হাওড়া সিটি পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বুধবার কে এস রায় হাসপাতাল থেকে গোপাল ধাড়া নামে এক রোগীকে বালিটিকুরির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু গোপালচন্দ্র কুণ্ডু নামে কাউকে ভর্তি করা হয়েছে কি না, তা পরিষ্কার ভাবে জানা যায়নি।
এর পরে শুক্রবার সকালে জানা যায়, গোপালবাবুকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থায় মঙ্গলবার রাত ৩টে ৫০ মিনিটে বালিটিকুরি ইএসআই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতালের শয্যার হেড টিকিটে লেখা হয়েছে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে বুধবার সকাল ৮টা ১০ মিনিটে। কিন্তু তার পরেও মৃতের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়নি কেন?
ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, প্রতিদিন ১০-১২ জন করে রোগী মারা যাচ্ছেন। রোগী ভর্তি হতে আসছেন তারও দ্বিগুণ। হাসপাতালটিতে যেহেতু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মর্গ নেই, তাই মৃত্যুর পরে মৃতদেহগুলি দ্রুত সরিয়ে পরবর্তী রোগীর জন্য শয্যা প্রস্তুত করে রাখতে হচ্ছে। হাসপাতালের দাবি, দ্রুত শয্যার ব্যবস্থা করতে গিয়ে কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোভিডে মৃতের দেহ আত্মীয়স্বজনদের দ্বারা শনাক্তকরণের পরে সাধারণত হাওড়া পুরসভার শববাহী গাড়ি করে শিবপুর শ্মশানে পাঠানো হয়। অভিযোগ, এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হাসপাতালের কর্মীদের একটি তোলাবাজ চক্র। অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, মৃতদেহ দ্রুত শনাক্ত করে শ্মশানে পাঠানোর জন্য আত্মীয়দের থেকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে। এমনকি, গোপালবাবুর দেহ দেখানোর জন্যও তাঁর পরিজনেদের থেকে ৩২০০ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
বাবার মৃত্যু সংবাদ পুলিশের কাছ থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই পেয়েছিলেন মেয়ে গোপা দত্ত। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে যা হল, তা আর কারও সঙ্গে যেন না হয়। বুধবার থেকে চূড়ান্ত হয়রানি তো হলই, এমনকি প্রায় ৫০ ঘণ্টা পরে বাবার দেহ দেখার জন্য হাসপাতালের কর্মীদের ৩২০০ টাকা আমাদেরদিতে হয়েছে।’’
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ওই হাসপাতালে কলকাতা পুরসভা থেকে গত বছর আসা কয়েক জন গ্রুপ ডি কর্মী এমনই চক্র চালাচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। তাঁরাই এখন হাসপাতালটির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। টাকা নিয়ে দেহ দেখানো হচ্ছে, ভর্তি করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছি। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’