Coronavirus in Kolkata

শপথ নিয়েছি আমরা, ‘আর কেউ প্রিয়াঙ্কা হব না’

মার্চের শুরু থেকেই আভাস আসছিল পরিবর্তনের। কোভিড কী, বুঝতে বুঝতেই লকডাউন শুরু হয়ে গেল।

Advertisement

স্বর্ণালী নস্কর

(এসএসকেএমের ফিমেল সার্জারি বিভাগের নার্স) শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২০ ০৩:০২
Share:

প্রতীকী ছবি

মার্চের শুরু থেকেই আভাস আসছিল পরিবর্তনের। কোভিড কী, বুঝতে বুঝতেই লকডাউন শুরু হয়ে গেল। তাই প্রথম দিকটা আমাদের টালমাটাল অবস্থা হচ্ছিল। কেমন হবে ডিউটির শিডিউল? কী ভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখব? পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার চিন্তাও ছিল সকলের।

Advertisement

তবে আমার সেই ভাবনা বেশি ছিল। কারণ, এগারো বছরের মেয়েটার দায়িত্ব শুধুই আমার। ওকে বাড়িতে একা রেখে নিশ্চিন্তে টানা ডিউটি করা সম্ভব ছিল না। যদি না এই মা-মেয়ের পাশে থাকতেন বন্ধুরা। ওঁরাই আমার পরিবার, আমার শক্তি। ডিউটির ঝুঁকি বুঝতে পেরেই মেয়েকে এক বান্ধবীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মাসির স্নেহে আগলে রাখতেন ওঁরা। আমপানে তাঁদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় তিন মাস ধরে মেয়ে রয়েছে আমার এক সিনিয়র দিদির বাড়িতে। সেখানেই বড় হচ্ছে ‘মিনি’।

ওর নাম আলিশা, ডাক নাম খুশি। এখন খুশির দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয় এক বা দেড় মাস।‌ নিজেকে আজকাল কাবুলিওয়ালার মতো মনে হয়। দু’-তিন দিন ছেড়ে ছেড়ে ভিডিয়ো কলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অবশ্য রহমতের ছিল না। অতএব আমার ভাগ্য এ ক্ষেত্রে প্রসন্ন।

Advertisement

আরও পড়ুন: করোনা-বিধি ভাঙছেন যাঁরা, সেফ হোমে কি আপত্তি তাঁদেরই

কিন্তু সন্তানকে সুদূর আফগানিস্তানে ফেলে আসা রহমতের মতোই অসহায় মনে হত আইসোলেশন ওয়ার্ডের ও পার থেকে। রোগীর পাশে যেতে না পারার যন্ত্রণা তাড়া করত। শুরুর দিকে তখনও পিপিই সে ভাবে আসেনি। জেনারেল ওয়ার্ডের ডিউটির ফাঁকেই আইসোলেশনের রোগী দেখতে হয় আমাদের। যখন তখন আইসোলেশনে ঢুকে সুরক্ষা কবচ নষ্ট করা ছিল সেই সময়ে চরম বিলাসিতা। এ দিকে দূর থেকে কোনও রোগীকে কষ্ট পেতে দেখেও বুঝতে পারছি না কাছে যাওয়া উচিত কি না। সামান্য কারণে বরাদ্দ পিপিই ব্যবহার করে পরে গুরুতর রোগীর কাছে যদি পৌঁছতে না পারি!

এখন সেই যন্ত্রণা অনেক কম। পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে বদলে ফেলেছি নিজেকে। হাসপাতালেই থেকে যাই। দিন তিনেক ছুটি পেলে তবেই টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে যাই। গরম জলে কাপড় কাচা, গরম জলে স্নান, কাচা আনাজ খাওয়ার সোডাযুক্ত জলে ডুবিয়ে তা রোদে শুকিয়ে নেওয়া— এ সবেই কেটে যায় একটা দিন। প্রতিদিন দু’বার গার্গল, তিন বার গরম জল খাওয়া, প্রোটিন খাবার বেশি করে খাওয়া এই রুটিন বেঁধে ফেলেছি। কাজের ফাঁকে সামান্য অবসর পেলেই টুকটাক হাতের কাজ করি। তাতে মনটাও ভাল থাকে।

এ ভাবে কত দিন? এই প্রশ্নটা দিনরাত তাড়া করে। পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে একা পথ চলার শুরু। মেয়ে সামলে, হাসপাতালের ডিউটি করে ব্যক্তিগত জীবনের আইনি জটিলতার ঝড়েও এত অসহায় লাগেনি। যতটা হয়েছিলাম দিন কয়েক আগে সতীর্থ প্রিয়াঙ্কা মণ্ডলের ছবির দিকে তাকিয়ে। স্মরণসভায় ফুলে ঢাকা ওই মুখের মধ্যে নিজের মুখ দেখে চমকে উঠছিলাম। আতঙ্কে না ডুবে একটা শপথ নিয়েছি আমরা, ‘আর কেউ প্রিয়াঙ্কা হব না’। প্রিয়াঙ্কারও এগারো বছরের একটি ছেলে আছে। এ বার দেড় মাস পরে মাকে পেয়ে খুশি যখন জাপটে ধরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিল, তখন মনে পড়ছিল ওর মনেও তো এমন ইচ্ছে হচ্ছে।

১৩ অগস্ট খুশির জন্মদিনে এসেছিলাম ওর সঙ্গে দিন তিনেক কাটাতে। ডিউটি থেকে ফিরেই রাত জেগে ওর পছন্দের কেক বানিয়ে, উইন্ডচাইম তৈরি করে আর সকলের উপহার নিয়ে যখন পৌঁছলাম, খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল ঘর জুড়ে। ওখানে পরিবারের ভালবাসা পাচ্ছে ও, তবু মনে হচ্ছে, কবে এই খুশিকে নিজের কাছে ধরে রাখব?

সব আগের মতো হবে? তবে ছোট ছোট পা ফেলে চলাই এখন ভাল। ভবিষ্যৎ ভাবনা না হয় তোলা থাক। অজানা আতঙ্ক মনকে দুর্বল করতে পারে।

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement