প্রত্যয়ী: ক্যাবেই অ্যাম্বুল্যান্সের পরিষেবা দিচ্ছেন টগরী। নিজস্ব চিত্র
হাতে অস্ত্র বলতে গাড়ির স্টিয়ারিং আর বর্ম ‘পিপিই কিট’। সেটুকু সম্বল করেই ডাক এলে বেরিয়ে পড়ছেন যুদ্ধের ময়দানে। গত প্রায় ১৫ দিন ধরে এ ভাবেই অসুস্থ মানুষজনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন বছর ছাব্বিশের তরুণী, অ্যাপ-ক্যাব চালক টগরী শীল। এখন আর আলাদা করে দিন-রাত নেই তাঁর। হেল্পলাইন নম্বরে ফোন এলেই বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে তাঁকে। রোগীই হোন বা তাঁদের আত্মীয়-পরিজন— অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকেই গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন অকুতোভয় এই তরুণী। বিশেষ এই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে আপাতত তিনি বন্ধ রেখেছেন অ্যাপ-ক্যাব সংস্থার হয়ে গাড়ি চালানোর কাজ।
কী ভাবে কাজ করছেন টগরী?
সিটু-অনুমোদিত অ্যাপ-ক্যাব চালকদের একটি সংগঠন সম্প্রতি শহরে অ্যাম্বুল্যান্সের অভাব মেটাতে রোগীদের পরিবহণে এই বিশেষ পরিষেবা চালু করেছে। তাদের সেই ডাকেই স্বেচ্ছায় কাজ করার জন্য এগিয়ে এসেছেন পার্ক সার্কাসের এক অটোচালকের মেয়ে টগরী। বৃদ্ধ বাবা এখন আর সব দিন অটো নিয়ে বেরোতে পারেন না। মা ঘরের কাজ সামলান। গত বছর লকডাউনের মধ্যেই নতুন পেশায় হাতেখড়ি হয় স্নাতক পাশ করা টগরীর। তাই আলাদা করে কঠিন সময় দেখার ভয় নেই তাঁর।
কী ধরনের পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে? দিন দুই আগে এক সকালে হেল্পলাইন নম্বর থেকে জানতে পারেন, ঢাকুরিয়ার কাছে এক বৃদ্ধ অসুস্থ। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। খবর পেয়েই ‘পিপিই কিট’ পরে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে টগরী জানতে পারেন, তাঁর বাড়ির
লোকজন তখনও হাসপাতালের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। এ দিকে, বিরাশি বছরের ওই বৃদ্ধ তখন জ্বরে কাবু। রিপোর্ট পজ়িটিভ। তাঁর শ্বাসেরও কিঞ্চিত সমস্যা হচ্ছে। বৃদ্ধকে গাড়িতে তুলে তাঁর এক নিকট আত্মীয় তখন বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা করার জন্য প্রাণপণ
চেষ্টা করছেন। প্রথমে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল এম আর বাঙুর হাসপাতালে। সেখানে ব্যবস্থা না হওয়ায় পরের গন্তব্য শরৎ বসু রোডের এক নার্সিংহোম। কিন্তু সেখানেও শয্যা না মেলায় গাড়ি এ বার ছুটল বাইপাস সংলগ্ন মুকুন্দপুরের এক নার্সিংহোমে। সেখানেও সুরাহা না হওয়ায় অবশেষে যেতে হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ক্যাবের মধ্যেই ওই বৃদ্ধকে এসে পরীক্ষা করেন কর্তব্যরত এক চিকিৎসক। ঘণ্টাখানেক ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তাঁকে স্টেরয়েড পাফ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন ওই চিকিৎসক। তার পরে ওই বৃদ্ধকে বাড়িতে রেখেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শ দেন তিনি। সকাল ১০টায় বেরিয়ে বিকেলে যখন ওই বৃদ্ধকে ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন টগরী, তত ক্ষণে ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে পাঁচটা ছুঁয়েছে।
দিন কয়েক আগে এক বিকেলে কুঁদঘাটের বাসিন্দা, পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা বাইপাসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীকে দেখতে যাওয়ার জন্য টগরীর গাড়িতে ওঠেন। হাসপাতালের কাজ মিটিয়ে বেরোতে তাঁর প্রায় ১১টা বেজে যায়। তাঁকেও নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে দেন টগরী। একই ভাবে যাদবপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও এক রোগিণীকে উত্তর কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। টগরীর কথায়, ‘‘গাড়ি চালানো শিখেছি বছর তিনেক আগে। রাস্তায় ভয় করে না আর।’’ নিজের স্কুল ‘সনৎ রায়চৌধুরী ইনস্টিটিউশন ফর গার্লস’-এর প্রধান শিক্ষিকার অনুরোধে সকালের দিকে ছাত্রীদের পড়িয়েছেন লকডাউনের আগে। পরিস্থিতি আগের মতো হলে সেই কাজও চালিয়ে যেতে চান টগরী। আর করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে নিজের জীবনযুদ্ধ হিসেবেই দেখেন তিনি।
সিটু-র অ্যাপ-ক্যাব চালকদের সংগঠনের সভাপতি ইন্দ্রজিৎ ঘোষ জানান, প্রতিটি গাড়িতে চালকের আসনের পিছনে প্লাস্টিকের পর্দা বসিয়েছেন তাঁরা। গাড়ি জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে নিয়মিত। যাঁরা এই বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করছেন, সেই সব চালককে পরপর দু’দিন কাজের পরে তিন-চার দিন বিশ্রাম দেন তাঁরা। যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়।