বিকল্প: করোনা-ভীতির জেরে বাদ পড়েছে করমর্দন। কনুইয়ে কনুই ছুঁইয়েই কুশল বিনিময়। মঙ্গলবার সকালে, রবীন্দ্র সরোবরে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
মরসুম বদলের সাধারণ সর্দি-কাশি, না কি করোনাভাইরাস— এই বিভ্রান্তির জেরে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বহু ক্ষেত্রেই তিলধারণের জায়গা নেই। ভিড় উপচে পড়ছে চিকিৎসকদের চেম্বারেও। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবায় রীতিমতো আতঙ্কের পরিবেশ। চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণ ভাবে কোনও রোগ নিয়ে মানুষের এমন আতঙ্ক, পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে এ ক্ষেত্রে আতঙ্ক থেকে যে বাড়তি সতর্কতার মনোভাব তৈরি হচ্ছে, তা ইতিবাচক। তাই শহরবাসীকে একেবারেই দোষ দিচ্ছেন না তাঁরা।
মরসুম বদলানোর সময়ে, বিশেষ করে শীত থেকে বসন্তের এই পর্বান্তরে বরাবরই বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। গত কয়েক বছর ধরে যা বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে মরসুমের বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ঘিরে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। ইএনটি চিকিৎসক দুলাল বসু বলছেন, ‘‘সর্দি-কাশি, ভাইরাল জ্বর তো রয়েছেই, কোনও কোনও বছর এই সময়ে কনজাংটিভাইটিসও দেখা যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরও উপেক্ষা করার ঝুঁকি নিচ্ছেন না রোগীরা। আমরাও তা করতে পারছি না।’’
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, করোনা সংক্রমণের শুরুর ধাপে এক জন রোগী গড়ে আরও ২.২ জনকে সংক্রমিত করছিলেন। যার জেরে সেই সময়ে প্রতি এক সপ্তাহ অন্তর সংক্রমণ দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক সপ্তাহেরও কম সময়ে এই সংক্রমণ দ্বিগুণ আকার ধারণ করছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক স্তরে করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করা এক গবেষক জানাচ্ছেন, সংক্রমণ ও অসুস্থ হওয়ার মধ্যে ব্যবধান থাকছে গড়ে ৪-৫ দিন। সেই সময়ের মধ্যেই সংক্রমিত রোগী থেকে আরও দু’জন, ওই দু’জন থেকে আরও চার জন, সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ওই গবেষকের কথায়, ‘‘ভাইরাল জ্বর আদৌ করোনা কি না, তা ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগছে। ওই মধ্যবর্তী সময়ে সংক্রমণের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকছে। ফলে এই মুহূর্তে সংক্রমণ কী ভাবে ছড়াচ্ছে, সেই ‘ট্রান্সমিশন ডায়নামিক্স’টাই বোঝার চেষ্টা চলছে।’’ যত ক্ষণ তা বোঝা না যাচ্ছে, তত ক্ষণ সর্দি-জ্বরেও স্বস্তিতে থাকার জো নেই।
মঙ্গলবারই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা, জমায়েত না করা বা অনুষ্ঠান বাতিল করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটাই যথেষ্ট নয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাত ধোয়া, অ্যালকোহলযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কারের পাশাপাশি সংক্রমণের উৎস খোঁজা এবং আইসোলেশন-এর ব্যবস্থা রাখাটাও সমান জরুরি। চিকিৎসক স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এমনিতেই তো কারও সাধারণ ভাইরাল জ্বর, সর্দি-কাশি হলে তাঁর থেকে দূরে থাকার কথা বলি। কারণ, তা ছোঁয়াচে। যাঁর সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বর হচ্ছে, তাঁকেও বলছি বাড়িতেই থাকুন। এ ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থেকে সেটাই করতে হবে।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সর্দি-কাশি-জ্বরের উপসর্গ দেখে তাঁদের পরামর্শ মতো প্যারাসিটামল বা প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেকে কয়েক দিন ঘরবন্দি রাখাও জরুরি। বক্ষরোগ চিকিৎসক রাজা ধর জানাচ্ছেন, সর্দি-জ্বর নিয়ে আসা রোগীর ‘ট্র্যাভেল হিস্ট্রি’ অর্থাৎ তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, করোনার সংক্রমণ সেখানে হয়েছে কি না, এ সব জানা গেলে রোগ চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়। যাঁদের আগে থেকেই সিওপিডি বা শ্বাসকষ্টজনিত অন্য অসুখ রয়েছে, সঙ্গে জ্বর-সর্দি-কাশিও রয়েছে, অথচ ‘ট্র্যাভেল হিস্ট্রি’ বা ‘কন্ট্যাক্ট হিস্ট্রি’ নেই, তাঁদের কেসভিত্তিক ভাইরাল জ্বর, সিওপিডি-র চিকিৎসা জরুরি। তবে জ্বর-সর্দি-শ্বাসকষ্টের কারণ খুঁজে না পাওয়া গেলে রোগীকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো দরকার বলে জানাচ্ছেন ওই চিকিৎসক। তাঁর কথায়, ‘‘উপসর্গ দেখা দিলে ১৪ দিনের জন্য স্বেচ্ছায় কোয়রান্টিনে থাকা দরকার। পরিবারের সদস্যদেরও ঘরবন্দি থাকতে হবে ওই দু’সপ্তাহ। আতঙ্কিত না হয়ে নির্দিষ্ট নিয়মগুলি মানলেই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’’