সর্পিল: করোনা-আতঙ্কের জেরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে লম্বা লাইন পড়েছে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। সোমবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
নির্দেশিকা কী বলছে, তা জানার প্রয়োজন নেই। তথাকথিত ‘সচেতন’ নাগরিকদের শুধু একটাই নিদান, বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল থেকে ‘করোনাভাইরাস-মুক্ত’ শংসাপত্র নিয়ে আসতে হবে! যার জেরে ওই হাসপাতালের দীর্ঘ লাইনই এখন করোনা-ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত শনিবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি আবেদনে বিদেশ বা ভিন্ রাজ্য থেকে আগতদের ১৪ দিন বাড়িতে থাকার অনুরোধ করেছিলেন। সেই আবেদনে সাড়া দিলেও আইডি হাসপাতাল থেকে শংসাপত্র আনার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন পুর এলাকার বাসিন্দাদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কসবার রামলাল বাজারের বাসিন্দা এক তরুণীর অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে সে কথা। গত ২০ মার্চ মুম্বই থেকে কলকাতায় ফেরেন ওই তরুণী। সোমবার তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত করোনার কোনও উপসর্গ (জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্ট) তাঁর নেই। কিন্তু সকালে কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিক বাসুদেব বসুর উপস্থিতিতেই আবাসনের বাসিন্দারা আইডি থেকে শংসাপত্র নিয়ে আসার জন্য চাপ দেন তাঁকে। ওই তরুণীর কথায়, ‘‘মুম্বই থেকে ফেরার পরে বাড়িতেই রয়েছি। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট না থাকলেও জোর করে আমাকে আইডি-তে পাঠানো হয়। তা না করলে পুলিশে জানানোর হুমকিও দেওয়া হয়।’’ পুরসভার সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য আধিকারিক অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, বিভিন্ন পুর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগে তাঁদেরও নাস্তানাবুদ অবস্থা।
সিঙ্গাপুর-ফেরত আর এক তরুণী যা দাবি করেছেন, তাতে অভিযোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, গত ১৬ মার্চ প্রবীণা মাকে নিয়ে টিটাগড়ের আবাসনে ফেরেন তিনি। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে তাঁকে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতরের ‘স্ক্রিনিং ডেস্ক’-এ কর্তব্যরত কর্মীরা জানান, উপসর্গ দেখা দিলে আইডি হাসপাতালে যেতে হবে। তরুণীর দাবি, তিনি সেই পরামর্শ মেনেই চলছিলেন। শনিবার আচমকা পুলিশকে নিয়ে আবাসনের বাসিন্দারা তরুণীর ফ্ল্যাটে হাজির হন। আইডি থেকে শংসাপত্র আনার জন্য তাঁরা চাপ দেন বলে অভিযোগ। নির্দেশ না মানায় পরদিন একই ঘটনা ঘটে। ‘জনতা কার্ফু’র দিন রাস্তায় কোনও গাড়ি ছিল না। তাঁরা সুস্থ কি না, সে ব্যাপারে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশা ভাড়া করেন মা ও মেয়ে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ সেই রিকশাওয়ালাকে তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ।
স্বাস্থ্য দফতরের করোনা কন্ট্রোল রুমে কর্মরত আধিকারিকদের একাংশ আবার বলছেন, তথ্য গোপন করে এক শ্রেণির মানুষ যে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছেন, সে কথা ঠিকই। কিন্তু যাঁরা নিয়ম মেনে চলছেন, তাঁদের সঙ্গে কিন্তু সহযোগিতা করাটাই কাম্য। সকলের ক্ষেত্রে একই রকম নিদান হলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা কেউ বুঝছেন না!
এই মন্তব্যের তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের সামনের দীর্ঘ লাইনে। সেখানকার চিকিৎসকদের একাংশ জানান, চাপে পড়ে শংসাপত্র আদায়ের জন্য এমন অনেক মানুষ ভিড় করছেন, যাঁদের হাসপাতালে আসার কোনও দরকারই নেই। ওই চিকিৎসকেদের মতে, ‘‘লাইনে দূরত্ব সংক্রান্ত কোনও সতর্কতা মানা হচ্ছে না। হাসপাতালের ওই ভিড় থেকে সুস্থ মানুষও সংক্রমিত হতে পারেন।’’
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক হেল্থ অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য সভাপতি সুরজিৎ ঘোষের মতে, ‘‘আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছেন কি না, তা তো সাধারণ মানুষ উপসর্গ দেখা না দিলে বুঝবেন না। সকলকে
বেলেঘাটা আইডি-তে পাঠানো ঠিক হচ্ছে না। ওই অপ্রয়োজনীয় ভিড়ে খাস হাসপাতাল চত্বরই সংক্রমণ ছড়ানোর শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে! অবিলম্বে আইডি-র মতো আরও কিছু স্ক্রিনিং সেন্টার চালু হওয়া উচিত।’’ এখনও তা হল না কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য ভবনেরই এক পদস্থ কর্তা।