—প্রতীকী ছবি।
পুজোর সময়ে দর্শকের ভিড় টেনে নাম করার প্রতিযোগিতা চলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। থাকে পুরস্কারের দৌড়ে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টাও। কারা কেমন থিম করছে, তা নিয়ে ব্যানার-হোর্ডিংয়ের প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যায় পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই। কিন্তু এ বার সব কিছুকেই যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে ‘ইউনেস্কো-প্রশংসিত’ তকমা পাওয়ার লড়াই। যা চরম আকার নিয়েছে ২৬টি পুজোর নাম ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে। রীতিমতো তাল ঠোকাঠুকি শুরু হয়েছে পুজোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে! ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সদস্য এক পুজোকর্তার সঙ্গে কার্যত মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার অবস্থা আর এক পুজোকর্তার!
ওই তালিকায় ২২টি বারোয়ারি থিম পুজো, দু’টি সাবেক পুজো এবং দু’টি বনেদি বাড়ির পুজোর নাম রয়েছে। যদিও তালিকায় জায়গা পেতে মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল কলকাতার আরও প্রায় ৭০-৮০টি পুজো কমিটি। কারণ, জানানো হয়েছিল, ১১ থেকে ১৪ অক্টোবর প্রতিনিধিদলের মণ্ডপ সফর চলবে। সেই জন্য কাজ শেষ করতে হবে ৮ তারিখের মধ্যে। কিন্তু তড়িঘড়ি কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তাই এখন দেখছেন, তালিকায় তাঁদের নাম নেই। ঠাঁই না-মেলা পুজো কমিটিগুলির এখন প্রশ্ন, মনোনয়ন করা হল কিসের ভিত্তিতে? তাদের দাবি, তালিকায় নাম থাকা কিছু পুজো গত চার-পাঁচ বছরে নাম করেছে। কিন্তু ১০০ বছর পেরোনো বা ভিড়ের নিরিখে প্রতি বারই শোরগোল ফেলা বহু পুরনো পুজো বাদ পড়েছে। একই ব্যাপার গত বছরও হয়েছিল বলে অভিযোগ। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের দাবি, ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা রেড রোডে ঘুরে যাওয়ার পরেই শহরের কিছু এলাকায় হলুদ কালিতে প্রশ্নচিহ্ন ছাপা ব্যানার দেখা গিয়েছিল। তাতে ইউনেস্কো এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের নাম ছিল। এমন ব্যানার তৈরি করা হয়েছিল প্রায় ১৩৫টি। একটি ব্যানার তাঁদের পুজো মণ্ডপের কাছেও লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সেটি খুলে নেওয়া হয়। পরে দেখা যায়, তালিকায় তাঁদের নাম নেই। এ বার তাঁরা আবেদনই জানাননি।
গত বছরের মতো এ বারও ব্রাত্য টালা বারোয়ারির পুজোকর্তা অভিষেক ভট্টাচার্য আবার বললেন, ‘‘আমাদের পুজো ১০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। সেই ঐতিহ্যে যদি ১০০ বছরের পুজোর অবদান না থাকে, তা হলে কাদের রয়েছে, ভাবছি!’’ সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তালিকায় শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবকে সাবেক পুজো হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। থিমের পুজোয় তাদের নাম নেই। অথচ, শ্রীভূমি থিমের পুজোর জন্যই পরিচিত। সাবেক পুজো করে যারা, সেই বাগবাজার বাদ!’’ একই ভাবে তালিকায় নেই সাবেক পুজোর জন্য পরিচিত একডালিয়া এভারগ্রিন। বাদ কলেজ স্কোয়ার, কুমোরটুলি পার্ক, কুমোরটুলি সর্বজনীন, মহম্মদ আলি পার্ক, দেশপ্রিয় পার্ক, লেক শিবমন্দিরের মতো পুজো। দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর উদ্যোক্তা সুদীপ্ত কুমার বললেন, ‘‘ঠিক কী দেখে মনোনয়ন হয়, আমার জানা নেই।’’ কুমোরটুলি সর্বজনীনের উদ্যোক্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য আবার বললেন, ‘‘চ্যানেল লাগে। চ্যানেল ছাড়া হয় না।’’ একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোকর্তা স্বপন মহাপাত্রের মন্তব্য, ‘‘সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমাখা এই পুজো সাবেক কি না, সেটা আর মানুষকে আলাদা করে বলে দিতে হয় না। ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা না দেখতে পেলে সেটা তাঁদের লোকসান।’’ তালিকায় না থাকা শিবমন্দিরের পুজোকর্তা পার্থ ঘোষের তির্যক মন্তব্য, ‘‘আসলে পুরনো পুজোর দর পড়ে যাচ্ছে।’’
তালিকায় জায়গা পাওয়া পুজোর উদ্যোক্তারা অবশ্য বিতর্কে ঢুকতে নারাজ। চোরবাগান সর্বজনীনের সম্পাদক প্রত্যুষা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আট তারিখের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। এ সব নিয়ে ভাবার সময় নেই।’’ একই দাবি হাতিবাগানের কাশী বোস লেনের পুজোকর্তা সৌমেন দত্তেরও। শ্রীভূমির পুজোকর্তা দিব্যেন্দু গোস্বামী বললেন, ‘‘আমরা কোথাও নাম দিই না। একটি সংস্থা অনুরোধ করেছিল, তাই ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদের এই ব্যাপারটায় রাজি হয়েছি।’’
ইউনেস্কোর পুজো পরিক্রমার নেপথ্যে থাকা সংস্থার অন্যতম মুখ তথা টালা প্রত্যয়ের পুজোকর্তা ধ্রুবজ্যোতি বসু ওরফে শুভকে এ ব্যাপারে জানতে ফোন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। তবে ওই সংস্থার তরফে শৈবাল দত্ত বলেন, ‘‘৬৩টি পুজো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশন-সহ আবেদন করেছিল। তিন জন বিদেশি শিল্পী বিচার করে নাম ঠিক করেছেন। তাই বিতর্কের কোনও ব্যাপার নেই।’’