উলটপুরাণ: যাঁর মূর্তি, নাম নেই তাঁরই। বদলে রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ফুটপাতে সিমেন্টে বাঁধানো পাটাতনের উপরে পর পর সাতটি মূর্তি। কোনওটির অবয়ব স্বামী বিবেকানন্দের মতো। কোনওটির আবার রাজা রামমোহন রায় বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। রয়েছে বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী এবং কাজী নজরুল ইসলামের আদলে গড়া মূর্তিও। কিন্তু, একটি মূর্তির নীচেও লেখা নেই, সেটি কার। নেই জন্ম বা মৃত্যুর তারিখও! উল্টে প্রতিটির নীচে লেখা, 'বিধায়ক: পরেশ পাল', 'সহযোগিতায় অলকানন্দা দাস'!
বেলেঘাটার আলোছায়া মোড়ের কাছে এই মূর্তিগুলিই এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। সেখানে নতুন তৈরি হওয়া একটি রেস্তরাঁ ও ব্যাঙ্কোয়েটের সামনেই রয়েছে মূর্তিগুলি। জানা গেল, ওই রেস্তরাঁ ও ব্যাঙ্কোয়েটের মালিকপক্ষই ফুটপাতের একাংশ বাঁধিয়ে ওই মূর্তিগুলি সেখানে বসাতে উদ্যোগী হন। সেই সূত্রেই শোনা যায়, ওই এলাকায় বিধায়ক পরেশ পালের দাপটের কাহিনি। অভিযোগ, তাঁকে ‘তুষ্ট’ না করা পর্যন্ত নাকি ওই রেস্তরাঁ-ব্যাঙ্কোয়েটের একটি ইটও গাঁথা যাচ্ছিল না। ওই রেস্তরাঁর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বললেন, "পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে বিপদ আছে। নেতা-দাদাকে খুশি করার চেষ্টার মধ্যেই আমাদের মালিকপক্ষ এলাকার সৌন্দর্যায়নের জন্য কিছু করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তখনই মনীষীদের মূর্তি বসিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আসে। তাই সাতটি মূর্তি বসিয়ে নীচে বিধায়ক ও স্থানীয় পুরপ্রতিনিধির নাম লিখে দেওয়া হয়েছে।"
এলাকাটি কলকাতা পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি অলকানন্দা দাস বলেন, "ওই মূর্তিগুলির কোনওটাই পুরসভা বা আমার উদ্যোগে বসানো হয়নি।" মূর্তি এবং তা ঘিরে বিতর্কের বিষয়ে কথা বলতে ফোন করা হলে পরেশ প্রবল উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এর পরে কটু মন্তব্য করে ফোন কেটে দেন।
স্থানীয়দের একটি বড় অংশেরই দাবি, ওই এলাকায় মূর্তি বসানো ঘিরে এমন বিতর্ক নতুন নয়। নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি মনীষীর মূর্তি বসাতে যাওয়ায় অতীতে পরেশের সঙ্গে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের বিবাদ হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে মাঝরাস্তায় বিশাল উঁচু মূর্তি বসানো নিয়েও। পরেশ জড়িত না হলেও কিছু দিন আগেই সামনে এসেছিল ওই এলাকার আরও এক মূর্তি-বিতর্ক। বেলেঘাটা মেন রোডে কংগ্রেসের উদ্যোগে স্থাপিত হয় ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’। পর পর তিনটি স্তম্ভে বসানো হয় মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীর মূর্তি। তবে, সেই ‘শহিদ সরণি’তে ফাঁকা থেকে যায় আরও একটি স্তম্ভ। সেখানে কার মূর্তি বসানো হবে, তা নিয়েই গোল বাধে। প্রথমে ঠিক হয়, ওই স্তম্ভে বসানো হবে নকশাল আন্দোলনে খুন হওয়া কংগ্রেস নেতা নারায়ণ করের মূর্তি। তবে, বেঁকে বসেন অন্য নেতারা। তাঁদের দাবি ছিল, বসাতে হবে তপেশ বসুর মূর্তি। পূর্ব কলকাতা ছাত্র পরিষদের তৎকালীন সভাপতি তপেশও নকশাল আন্দোলনে খুন হন। দু'পক্ষের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত ফাঁকাই রয়ে যায় স্তম্ভটি। সমাধান হিসাবে স্তম্ভের নীচে মৃত্যুর তারিখ-সহ লিখে দেওয়া হয় নারায়ণ এবং তপেশের নাম।
যদিও এই ধরনের কাজ আদতে বিশিষ্ট মানুষদের অপমান বলেই মনে করেন বরাহনগরের নৈনানপাড়া লেনের বাসিন্দা, বছর তিরাশির মধুসূদন মাজি। অনেকেই তাঁকে চেনেন ‘মূর্তি ম্যান’ নামে। কোথাও কোনও মূর্তির নীচে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম বা জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লেখা না থাকলে বা এই সব তথ্যে ভুল থাকলেই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে চিঠি দেন তিনি।
২০১২ সালে রবীন্দ্র সদনে রবীন্দ্রনাথের বড় মূর্তির নীচে নাম কেন লেখা নেই, তা জানতে চেয়ে তিনি রবীন্দ্র সদনের তৎকালীন প্রশাসনিক আধিকারিককে চিঠি পাঠান। কর্তৃপক্ষ মূর্তির নীচে রবীন্দ্রনাথের নাম এবং জন্ম-মৃত্যুর তথ্য লিখলেও মৃত্যুর তারিখে ভুল ছিল। আবার তা সংশোধন হয় মধুসূদনবাবুরই চিঠিতে।
একই ভাবে কলকাতা ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের রবীন্দ্র-মূর্তি, বাবুঘাটের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মূর্তি, ময়দান এলাকায় মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি এবং আকাশবাণী ভবনের সামনে চিত্তরঞ্জন দাশের মূর্তির নীচেও নাম ও জন্ম-মৃত্যুর তথ্য লেখা হয়েছে মধুসূদনবাবুর চিঠির চাপে।
এ ক্ষেত্রে কী করণীয়? মধুসূদনবাবু বলেন, "বিধায়ক, পুরপ্রতিনিধিদের বুঝতে হবে, মূর্তির নীচে নিজেদের নাম লিখে দিয়ে প্রচার পাওয়ার চেষ্টা আদতে মনীষীদেরই অপমান করা। আর যাঁরা এ জিনিস দেখেও প্রতিবাদ করেন না, তাঁদের বুঝতে হবে, এ তোমার পাপ। এ আমার পাপ।"