বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির সেই রিপোর্ট
বছর ঘোরার মুখে আচমকা মোড় ঘুরে গেল। যাদবপুরের সেই সাড়া জাগানো ছাত্র আন্দোলনের ‘উৎসমুখেই’ দানা বাঁধল বিভ্রান্তির মেঘ।
এক বছর আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে উথালপাথাল হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তার জেরে শিক্ষাঙ্গনে নজিরবিহীন পুলিশি আক্রমণ দেখেছিল রাজ্য। দানা বেঁধেছিল ‘হোক কলরব’ আন্দোলন, যার আঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরে, ভিন রাজ্যে, এমনকী বিদেশেও। রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হয়। শেষমেশ সরে যেতে হয় তৎকালীন উপাচার্যকে। কিন্তু তদন্ত সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি বলেছে, ছাত্রীটির উপরে যৌন নির্যাতনের কোনও প্রমাণ মেলেনি। ঘটনাটিকে বড় জোর যৌন হেনস্থার পর্যায়ে ফেলা যায় বলে তাদের অভিমত।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি)-র ওই রিপোর্ট গত নভেম্বরেই কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়ে গিয়েছিল। অথচ এই ন’মাসেও তা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল (ইসি)-এ পেশ হয়নি। ফলে সোমবার পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তা প্রকাশিত হয়নি। রিপোর্টটি সম্প্রতি আনন্দবাজারের হাতে এসেছে।
যাদবপুরের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রীটি গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে একটি অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। তাতে তিনি জানান, ২৮ অগস্ট (২০১৪) রাতে ‘ফেস্ট’ চলাকালীন তিনি এক সহপাঠীকে নিয়ে ওপেন এয়ার থিয়েটার (ওএটি)-এর কাছে শৌচালয় খুঁজতে গিয়ে আক্রান্ত হন। মেয়েটির অভিযোগ: ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক ছাত্র দলবল নিয়ে ওঁদের মারধর করে, এমনকী তাঁকে ক্যাম্পাসের ভিতরে নিউ পিজি হস্টেলের একটি ঘরে নিয়ে দরজা আটকে যৌন নির্যাতনও চালানো হয়। শেষে অসুস্থ অবস্থায় তিনি সম্পর্কিত এক দাদার সঙ্গে বাড়ি ফেরেন।
ইসি’র সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইসিসি তদন্তে নামে। অধ্যাপক সুমিতা সেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিটি অভিযোগকারিণী ও তাঁর সেই সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে। অভিযুক্ত পড়ুয়া, হস্টেলের কর্মচারী, আবাসিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পাশপাশি ‘যৌন নির্যাতনের’ প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। উপাচার্য পদ থেকে অভিজিৎবাবুকে সরতে হয়। ইতিমধ্যে ঘটনার দু’মাসের মাথায়, গত ৫ নভেম্বর আইসিসি’র ৩১ পাতার রিপোর্ট জমা পড়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য (বর্তমানে সহ উপাচার্য) আশিস বর্মার কাছে।
কিন্তু তা আর ইসি’তে জমা পড়েনি। গত মার্চে ইসি’র তরফে রিপোর্ট চাওয়া হলেও লাভ হয়নি। অর্থাৎ, গুরুতর অভিযোগটি সম্পর্কে তদন্তের সুপারিশ যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাই এখনও অন্ধকারে। ইসি’কে রিপোর্ট দেওয়া হল না কেন?
আশিসবাবুর জবাব, ‘‘আমি সহ উপাচার্য। কিছু বলার এক্তিয়ার নেই। যা বলার, উপাচার্য বলবেন।’’ যাদবপুরের নতুন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস সোমবার বলেন, ‘‘ওই সময়ে আমি ছিলাম না। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছি। ইসি’কেও জানাব। তারা যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই হবে।’’ এ দিকে অভিযোগকারিণী গত সপ্তাহে আনন্দবাজারের কাছে দাবি করেছিলেন, তাঁর সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আইসিসি রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। কী রকম?
রিপোর্টের উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘ওই রাতে হস্টেলের কিছু ছেলের সঙ্গে অভিযোগকারিণী ও তাঁর বন্ধুর বচসা, ধস্তাধস্তি হয়েছিল। কমিটির পর্যবেক্ষণ: মেয়েটির প্রতি যে ধরনের ভাষা প্রয়োগ করা হয় ও যে ভাবে ধস্তাধস্তি হয়, তা যৌন হেনস্থার সামিল। তবে অভিযোগকারিণীর বয়ান ও পারিপার্শ্বিক তথ্যের ভিত্তিতে যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হস্টেলের ফাঁকা ঘরে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণও মেলেনি। ‘অভিযোগ পত্রের সঙ্গে ওঁর বয়ানেও বিস্তর ফারাক।’— মন্তব্য রিপোর্টে।
অভিযোগকারিণী কী বলছেন? সোমবার ছাত্রীটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘যা বলার, বাবা বলবেন।’’ মেয়েটির বাবা বলেন, ‘‘আমরা রিপোর্টে সন্তুষ্ট নই। এর বিরুদ্ধে আইনের পথে যাব।’’ আইনের পথে বলতে কী বোঝাতে চাইছেন জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘‘এ নিয়ে আর কথা বলব না। আমাকে বা আমার মেয়েকে ফোন করবেন না।’’
কিন্তু ওঁর মেয়ের ‘নিগ্রহের’ প্রতিকার চেয়ে সে দিন যাঁরা পথে নেমেছিলেন, আইসিসি রিপোর্টের সারমর্ম শুনে তাঁদের অনেকে ধন্দে পড়েছেন। কারও কারও প্রশ্ন, ‘‘তা হলে
আমাদের এমন জোরদার আন্দোলন করে লাভ কী হল?’’ রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে যাদবপুরের আন্দোলনের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে বলেও অনেকের আশঙ্কা। যদিও ‘হোক কলরব’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা ও ফেটসু’র চেয়ারম্যান শুভব্রত দত্তের বক্তব্য, ‘‘যে কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি নেই, তাদের রিপোর্ট নিয়ে মাথাব্যথাও নেই।’’ তবে কি ওঁরা ফের আন্দোলনে নামবেন?
শুভব্রত বলেন, ‘‘নতুন উপাচার্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আইসিসি-তে ছাত্র প্রতিনিধি রাখার ব্যাপারে ইসি’তে আলোচনা করবেন। আপাতত ওঁর আশ্বাসে আমরা আস্থা রাখছি।’’
সে দিন কলরবের পাশে দাঁড়ানো শিক্ষাবিদদের অনেকেও কিন্তু রিপোর্ট শুনে বিস্মিত। তবে রিপোর্ট যে ভাবে এত দিন ‘চেপে’ রাখা হয়েছে, তা নিয়েও ওঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘এত গোপনয়ীতা কেন? কিছু কি আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে?’’ ওঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ রিপোর্টটি ইসি’তে পেশ না-করে মস্ত ভুল করেছেন। যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ইসি’র বৈঠকে রিপোর্ট পেশ ও কোনও সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত শেষ হতে পারে না।’’ জুটা’র সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত বলেন, ‘‘আমি রিপোর্ট দেখিনি। তাই মন্তব্য করব না।’’
তার পরেও কিন্তু আম পড়ুয়াদের মধ্যে বিভ্রান্তি কাটছে না। এমন আন্দোলনে নামার আগে আরও সতর্ক হয়ে পা ফেলার কথাও এখন শোনা যাচ্ছে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রী মহলে।