ফাইল চিত্র।
শীতের সময়ে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পার্টিকিউলেট ম্যাটার বা পিএম) নিরিখে শহর ও শহর সংলগ্ন যে সমস্ত এলাকা দূষণের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত, ঘটনাচক্রে তাদের মধ্যেই একাধিক জায়গা গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে বাজি-দূষণের ‘হটস্পট’-ও। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য এমনই বলছে। অথচ চলতি বছরে সব রকমের বাজি নিষিদ্ধের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট, কলকাতা হাইকোর্ট, জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও সেই সমস্ত জায়গা থেকে শনিবার, কালীপুজোর দিন বাজি ফাটানোর অভিযোগ এসেছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। ফলে এক দিকে ধূলিকণার দূষণ ও অন্য দিকে বাজির দূষণ— দুইয়ে মিলে শহরের ওই কয়েকটি জায়গা ‘দূষণ-ক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের আরও বক্তব্য, করোনা সংক্রমণ ও তার জেরে আদালতের রায়ে বাজি-দূষণ বন্ধের জন্য একটা আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা কতটা বাস্তবায়িত করা গেল, তা নিয়ে এ দিনের পরে যথেষ্ট সংশয় থাকছে।
এমনিতে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর (নিরি) তথ্য বলছে, বাতাসে পিএম-এর উপস্থিতির নিরিখে দেশের মধ্যে কলকাতা সব সময়েই প্রথম সারিতে থাকে। যেমন, ২০১২-’১৫ সালে দেশের বিভিন্ন শহরের বাতাসে পিএম-এর উপস্থিতি নিয়ে নিরি-র করা সমীক্ষায় কলকাতা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু তার পরে গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিক ভাবে শহরের বাতাসের মানের অবনমন হয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকদের একাংশ।
আরও পড়ুন: রায়ের পরেও বদলাল না বাজির ‘হটস্পট’!
নিরি সূত্রের খবর, গ্রীষ্মের তুলনায় শীতে এমনিতেই কলকাতা ও হাওড়া, দুই শহরের বাতাসে পিএম-এর পরিমাণ অনেকটাই বেশি থাকে। নিরির এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘এই স্বাভাবিক। কারণ শীতে বাতাসের গতি থাকে না। ফলে দূষকগুলি এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।’’ তথ্য অনুযায়ী, শীতকালে পিএম১০-এর উপস্থিতির নিরিখে শহরের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে শ্যামবাজার (পিএম১০-এর উপস্থিতি সহনমাত্রার থেকে প্রায় ছ’গুণ বেশি)। যেখানে প্রতি ঘনমিটারে পিএম১০ থাকার কথা ১০০ মাইক্রোগ্রাম, সেখানে শ্যামবাজারে ওই পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৬৩২.৫ মাইক্রোগ্রাম। হাওড়ার ক্ষেত্রে পিএম১০-এর উপস্থিতির নিরিখে শীর্ষস্থানে রয়েছে হাওড়া ময়দান (প্রতি ঘনমিটারে ৬১০ মাইক্রোগ্রাম)। আবার অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম২.৫) উপস্থিতির নিরিখে শহরের মধ্যে মৌলালি প্রথম স্থানে (পিএম২.৫-এর উপস্থিতি সহনমাত্রার থেকে প্রায় চার গুণ বেশি)। যেখানে প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ৬০ মাইক্রোগ্রাম থাকার কথা, সেখানে মৌলালিতে তার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ মাইক্রোগ্রাম। হাওড়ার ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে ফের সেই হাওড়া ময়দানই (পিএম২.৫-এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৩৭৯ মাইক্রোগ্রাম)। পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে শ্যামবাজার, মৌলালি, এন্টালি-সহ কিছু জায়গা থেকে বাজির অভিযোগ এসেছে। আগে এ সব জায়গা থেকে অতটা অভিযোগ আসত না। ফলে বলা যেতে পারে, ওই জায়গাগুলি বাজি-দূষণের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন।’’
পর্ষদের এক কর্তা বলছেন, ‘‘যে কোনও বাজিই যে খারাপ, তা প্রতি বছর বলা হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ হয়তো তার গুরুত্ব আরও ভাল ভাবে বোঝাতে পেরেছে। এর পরেও আমরা সতর্ক না হলে তা দুর্ভাগ্যজনক।’’ পরিবেশ সংক্রান্ত মামলার আইনজীবী পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাজির উপরে এই নিষেধাজ্ঞা প্রতি বছর বহালের জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের সক্রিয়তা প্রয়োজন।’’ জাতীয় পরিবেশ আদালতে বায়ুদূষণ সংক্রান্ত মামলার আবেদনকারী পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘পরিবেশ আদালতে বায়ুদূষণের মামলা চার বছর ধরে চলছে। তার পরেও রাজ্যের তরফে দূষণ-রোধে তেমন প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। এ বছর সেই সুযোগটা তৈরি হয়েছিল। সেটা কতটা নিতে পারলাম, তা নিয়ে সংশয় থাকল।’’রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, শনিবার রাত ১১টা পর্যন্ত বাজি সংক্রান্ত ৩০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। জেলার পাশাপাশি শহরের হরিদেবপুর, বেহালা, বেলেঘাটা, ভবানীপুর, কালীঘাট-সহ একাধিক এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে। যদিও পর্ষদ কর্তারা জানাচ্ছেন, বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকটি জায়গায় বাজি ফাটলেও মোটের উপর শান্তিপূর্ণই ছিল এ বারের কালীপুজোর রাত। যদিও ‘সবুজ মঞ্চ’ সূত্রের খবর, রাত ৮টা পর্যন্ত বেশির ভাগই জেলা থেকে অভিযোগ আসছিল। কিন্তু রাত বাড়তেই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযোগ আসা শুরু হয়। এ দিন রাত পর্যন্ত ৫০টির মতো অভিযোগ এসেছে সংগঠনের কন্ট্রোল রুমে। কসবা, রাজডাঙা, বাঙুর, জোকা, সার্ভে পার্ক, সন্তোষপুর, পর্ণশ্রী, যাদবপুর, বেহালার মতো এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে।