ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
অন্তহীন কোলাহল, যানবাহনের তীব্র আওয়াজ আর অবিরাম বিকিকিনি। এরই মাঝে অতিবাহিত হয় এ পাড়ার জীবনযাত্রা। এটাই আমার পাড়া— ফ্যান্সি মার্কেট সংলগ্ন কার্লমার্কস সরণি। অতীতে রাস্তাটির নাম ছিল সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোড। এক কালের বর্ধিষ্ণু অঞ্চলটা এখন একটা বাজারি পাড়ায় বদলে গিয়েছে। রাস্তার দু’ধারে নতুন-পুরনো বাড়ির অধিকাংশই ঢেকেছে অতিকায় হোর্ডিং-এ। তাই হঠাৎ দেখলে পাড়ার আসল চেহারাটা ঠাহর করা যায় না।
বাড়তে থাকা বাণিজ্যিক প্রভাবে কমেছে সম্পর্কের উষ্ণতা। হারিয়ে গিয়েছে পাড়া পাড়া আবহাওয়াটা। অনেক পুরনো বাসিন্দা অন্যত্র চলে গিয়েছেন। নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অপরিচিত। দেখতে দেখতে এই অঞ্চল থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেন উধাও হয়ে গেল। আগে পাড়া মানেই তো ছিল সুখ-দুঃখ একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। এখন কমেছে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ। আগে এ পাড়ায় যাঁরা থাকতেন একে অপরকে চিনতেন। হাতে গোনা পরিচিত যাঁরা আছেন, তাঁদের পরবর্তী
প্রজন্মের অনেকেই বিদেশে থিতু। এখন নিঃসঙ্গ অভিভাবকদের সন্ধ্যা থেকে রাত কাটে সন্তানের একটি ফোনের অপেক্ষায়।
আগে প্রতিটি বাড়ি সংলগ্ন ছিল রক। সেখানেই বসত আড্ডা। আসতেন বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ মানুষ। সে ছবি হারিয়েছে বহু দিন। এখন আড্ডা দেওয়ার জায়গা কোথায়? কিছুটা দূরে ফুটপাথের চায়ের দোকানে মাঝেমাঝে কিছু মানুষকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। বাজারি সম্প্রসারণের ফলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও হারিয়েছে প্রাণটা। কমেছে এ অঞ্চলের গাছপালার সংখ্যাও। এখন রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য দোকান। হাঁটাচলা করাই দায়। তাই বেশির ভাগ মানুষ ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে হাঁটেন। সময়ের সঙ্গে তাল
মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন বাণিজ্যিক বিপণি।
আগের মতো খেলাধুলোর পরিবেশ এখন নেই। হয়তো পড়াশোনার চাপে ছোটদের খেলার আগ্রহ কমেছে। আগে পাশের গলিতে খেলা হত ক্রিকেট, ফুটবল। ছেলেবেলায় খেলার ব্যাট না জুটলে ভাঙা গ্যাসের পাইপ দিয়ে ক্রিকেট খেলা হত। এখন কমেছে খেলার মাঠের সংখ্যাও। কিছু কিছু মাঠ ঘিরে হয়েছে সৌন্দর্যায়ন। সেখানে অনেকেই সকাল-সন্ধ্যায় বেড়াতে যান।
কিছু সমস্যা থাকলেও এলাকাটা নিরাপদ। গভীর রাত পর্যন্ত মহিলারা নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারেন। পুর-উদ্যোগে রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ হলেও বাজারি এলাকা হওয়ায় সব সময়ে রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন থাকে না। দেওয়ালে পানের পিক আর প্লাস্টির বন্দি আবর্জনা রাস্তায় মাঝেমধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
জীবনের অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ পাড়াটা। এখানেই প্রথম স্কুলে যাওয়া। সেখানে এক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষকের সান্নিধ্য যা আমার জীবনদর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। আজকের পাড়া আর অতীতের পা়ড়া যেন দুই ভিন্ন জগৎ। আগে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান-অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। তবে এই অঞ্চলে দেশ ভাগের পরে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা কমতে থাকে। আমাদের পাড়ায় এখানে মূলত হিন্দু এবং মুসলমানেরা বসবাস করেন। সবার মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতির সম্পর্ক।
পাশেই ডেন্ট মিশন রোডে ছিল সাহেবপাড়া। সেখানে আজ মাথা তুলেছে অসংখ্য বহুতল। কাছাকাছি কয়েকটি ক্লবের উদ্যোগে হয় দুর্গাপুজো। এই সব পুজোর
জাঁক-জমক বাড়লেও কমেছে পুজোর আন্তরিকতা। কিছুটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে এ পাড়ার বাঙালিয়ানা।
এখানেই গত সাত পুরুষ আমাদের বসবাস। এক কালে এখানেও ছিল সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ। এক কালে আমাদের বাড়িতে এসেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীন্দ্র চৌধুরী, শিশির ভাদুড়ী প্রমুখ। এখন কোলাহলের মাঝে হারিয়ে গিয়েছে ফেরিওয়ালার ডাকের মতো অনেক কিছুই। বাস্তবের পাড়াটায় শুধু মিশে আছে স্মৃতি।
লেখক শিক্ষক